বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের মাতব্বরি দরকার নেই -পররাষ্ট্রমন্ত্রী

13

স্টাফ রিপোর্টার :
বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের ‘মাতব্বরি’ দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ওনারা আগে নিজেদের আয়নায় দেখুক। গতকাল রবিবার দুপুরে সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট কার্যক্রমের উদ্বোধন শেষে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) ১৪ বারে স্পিকার নির্বাচিত করেছে। আমাদের দেশে তো এরকম কোনো ঝামেলা নাই। আমেরিকার ৮২ না ৭২ পার্সেন্ট (শতাংশ) জনগণ মনে করে আমেরিকার ডেমোক্রেসি খুব দুর্বল। আর রিপাবলিকান পার্টির ৭৭ পার্সেন্ট মনে করে যে, গত প্রেসিডেন্সি ইলেকশন ছিল ফ্রড ইলেকশন এবং দে হ্যাভ স্টোলেন দ্য ইলেকশন (তারা ভোট চুরি করেছে)। এই রকম তাদের মনমানসিকতা। আমাদের দেশেও কিছু লোক এই ধরনের আছে। ড. মোমেন বলেন, ওই দেশে (যুক্তরাষ্ট্রে) অ্যাভারেজ কতজন লোকে ভোট দেয়? পঞ্চাশের (শতাংশ) নিচে ভোট দেয়। আর আমাদের দেশে ৭২, ৮০, ৯০ পার্সেন্ট লোকে ভোট দেয়। এই গাইবান্ধায় ৮৬ পার্সেন্ট ভোট পড়েছে। আমাদের দেশে ইলেকশন খুব স্বতঃস্ফূর্ত হয়। আনন্দময় হয়। ওইসব দেশে ইলেকশনের এক মাস আগে ক্যাম্পেইন শুরু হয়, আমাদের এক বছর আগেই শুরু হয়ে যায়।
তিনি বলেন, যখন সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার মেজরিটি পেলো, তাদেরকে সরকার গঠন করতে দিলো না। তখনই তো আমরা আন্দোলন শুরু করলাম। তারপর জেনোসাইড হওয়ার পর আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। এই দেশের (বাংলাদেশ) সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। এই দেশের প্রত্যেক মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই প্রিন্সিপলগুলো আছে। সো আমাদের অন্যরা মাতব্বরি করে এই পরামর্শ দেওয়ার দরকার নাই। উনারা নিজেদের আয়নায় দেখুক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেছেন যে, আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ, সুন্দর, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক, সবাইকে নিয়ে আমরা করতে চাই। আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি, আমার দল বিশ্বাস করে, আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো। এটা আমার সেøাগান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছে। কোনোদিন মিলিটারি এনে বা অন্য কৌশল করে সরকার হয় নাই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন, এক্ষেত্রে নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, কোনো সমস্যা নেই। (বিদেশি পর্যবেক্ষক) আমরা অ্যালাউ করবো। উই হ্যাভ নাথিং টু হাইড (আমাদের গোপন করার কিছুই নেই)। মন্ত্রী আরও বলেন, অন্যরা মাতব্বরি করতে পারেন। কিন্তু দে শ্যুড ফলো আস, আওয়ামী লীগ সবসময় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ওই সম্পর্কে উনারা যে বিভিন্ন সন্দেহ পোষণ করেন, তাদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব, জ্ঞানের অভাব। তারা হয়তো জিনিসগুলো ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করছেন না বলে অনেক সময় অনেকগুলো অবান্তর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। আমি আশা করবো, তারা আমাদের ইতিহাস পড়ুক আর আমাদের চলার পথটা দেখুক। আমাদের দেশটাই হচ্ছে ডেমোক্রেসির একটা কেন্দ্রবিন্দু।
এসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নুরুল আনোয়ার, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জগদীশ চন্দ্র দাস উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রবিবার সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অভিবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত ও সেবার মান বাড়াতে বিমানবন্দরে ৬টি ইলেকট্রনিক গেট (ই-গেট) এর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে ই-পাসপোর্টধারীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে মাত্র ১৮ সেকেন্ড ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দর সংশি¬ষ্টরা।
সংশি¬ষ্ট সূত্রে জানায়, ই-গেট চালুর মাধ্যমে বিমানবন্দরের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। ই-পাসপোর্টে থাকা মাইক্রোপ্রসেসর চিপ এবং অ্যান্টেনা স্ক্যান করে ই-গেট পাসপোর্টধারী ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করবে। যাত্রীরা ই-গেটে পাসপোর্ট দেওয়ার পরই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খুলে যাবে ফটক। কিছু সময়ের মধ্যে শেষ হবে বিদেশগামীদের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম। যাত্রী নিজে নিজে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন। এজন্য কোনো কর্মকর্তার প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে না।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা যাড, ই-গেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেড এরই মধ্যে ই-গেট মেশিন স্থাপনসহ সব কাজ সম্পন্ন করেছে। যাত্রীদের বহির্গমনের জন্য তিনটি এবং প্রবেশের জন্য তিনটি গেট চালু থাকবে। এই সেবা সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে যাদের ই-পাসপোর্ট আছে তারাই পাবেন।
সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ বলেন, ই-গেট চালু হলে প্রবাসীদের ভোগান্তি লাঘব হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হবে। প্রবাসীদের কথা চিন্তা করেই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ইমিগ্রেশন সিস্টেমকে আরও নিরাপদ ও দ্রুততর করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও অথেনটিকেশন খুব কম সময়ে হবে।
এর আগে বাংলাদেশে ই-গেট কার্যক্রম শুরু হয় ২০২১ সালের ৩০ জুন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসানো ই-গেটের উদ্বোধন হয়েছিল সেদিন। সেখানে ২৬টি ই-গেট চালু রয়েছে। এরপর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও ৬টি ই-গেট চালু করা হয়। সর্বশেষ সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরও ৬টি ই-গেট চালুর মাধ্যমে বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে নতুন মাত্রা যোগ করল বাংলাদেশ।
জানা গেছে, যশোরের বেনাপোল ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আরও ই-গেট স্থাপন করা হবে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এসব ই-গেট স্থাপন করলেও এগুলো পরিচালনা করবে ইমিগ্রেশন বিভাগ।
সংশি¬ষ্টরা জানান, ই-পাসপোর্ট এর মাধ্যমে একজন বিদেশগামী কারও সাহায্য ছাড়া নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। পুরো প্রক্রিয়াটি এক মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন হবে। পৃথিবীতে এর চেয়ে নিরাপদ ও সর্বাধুনিক প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন হয়নি। বিশ্বের ১১৮টি দেশে ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ হলো ১১৯তম দেশ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ই-গেট বাংলাদেশে প্রথম। ই-পাসপোর্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে ঢাকার পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সকল বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্ট সেবা চালু হয়েছে।
ই-গেটের সুবিধা
আন্তর্জাতিক ভ্রমণে একজন যাত্রীর পরিচয়পত্র তার পাসপোর্ট। পুরোনো পাসপোর্টের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত ই-পাসপোর্ট। এটি এমন এক ধরনের ইলেক্ট্রিক সিস্টেম যার কভারে একটি চিপ থাকে। যার মধ্যে থাকে পাসপোর্ট বহনকারীর তথ্য, সেই সাথে তথ্য জালিয়াতি থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থা। পুরনো এমআরপি পাসপোর্টে দশ আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলেও ই-পাসপোর্টে তা রয়েছে। এর মাইক্রোপ্রসেসরে একজন ব্যক্তির বায়োমেট্রিক ও বায়োগ্রাফিক ৪১টি তথ্য থাকে। এর মধ্যে ২৬টি তথ্য খালি চোখে দেখা যায়। ২টি বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে যা বিশেষ যন্ত্র ছাড়া পাঠ করা যায় না।
স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় একজন ব্যক্তির ই-পাসপোর্টের তথ্য পড়ার জন্য ই-গেট ব্যবহার করা হয়। এখানে মাইক্রোপ্রসেসরে থাকা বায়োমেট্রিক ও বায়োগ্রাফিক তথ্য যাচাই করে পাসপোর্টধারীকে শনাক্ত করা হয়। যেহেতু ই-গেটে পাসপোর্টের সাথে সাথে ব্যক্তির ভিসাও যাচাই করা হয়, তাই ই-গেট সুবিধায় একজন পাসপোর্ট বহনকারী নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারেন। এতে সাধারণ ইমিগ্রেশনে যতো সময় লাগে তার থেকে অনেক কম সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ করা যায়। তবে এ সুবিধার জন্য আগে ইমিগ্রেশন পদ্ধতিকে অটোমেশনে আনতে হবে। আবার ই-গেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভিসা ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের সংযোগও থাকতে হবে।
এদিকে সিলেটে আরেকটি পাসপোর্ট অফিস করার তাগিদ দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট ১ আসনের সাংসদ ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন। রবিবার সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আরেকটি পাসপোর্ট অফিসের জন্য তাগিদ দেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিলেটের বর্তমান পাসপোর্ট অফিস যেখানে আছে সেখানে সেবাপ্রত্যাশীদের নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। চাহিদার তুলনায় সেবা কম পাওয়ায় অভিযোগ উঠেছে পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে। কিন্তু বর্তমান সরকার মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য সবকিছু সহজ করে দিচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি নিজেই সিলেটের পাসপোর্ট অফিস দেখেছি। এখানকার রাস্তা খুবই সরু। কেউ যদি অসুস্থ লোককে নিয়ে আসে তাদের জন্য খুবই কষ্টকর। প্রতিদিন হাজার হাজার পাসপোর্ট জমা হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে সেগুলো দেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। পাসপোর্টের জন্য সাধারণ মানুষের হাহাকার কথা উলে¬খ করে মন্ত্রী বলেন, সময় মত পাসপোর্ট না পেলে জনগণ নানা অভিযোগ করেন তাদের অনেক অভিযোগ সত্য এবং অনেক অভিযোগের সত্যততা থাকে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে স্বররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সিলেটে আরেকটি পাসপোর্ট অফিসের করার জন্য বলেছি। নতুন একটি পাসপোর্ট অফিস হলে তিলকে তাল করে কেউ অভিযোগ করতে পারবেন না। সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এতে জনগণও সঠিক সময়ে সেবা পাবে।
ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন বলেন, সিলেটের বিরাট সংখ্যক মানুষের দ্বৈত্য নাগরিকতত্ব আছে আমাদের যারা ডুয়েল সিটিজেন আছেন তাদেরকে নো ভিসা সার্ভিস আরো বেগবান করতে হবে যাতে করে প্রবাসীরা আরো দ্রুত এই সার্ভিস পায়। ই- গেইট চালু হওয়াতে সুবিধাভোগীদের অনেক উপকারে আসবে। বিশেষ করে প্রবাসীরা দেশে আসলে নানা ধরনের দুর্ভোগের মুখে পড়েন। এটি চালু হওয়ায় অনেকটা দুর্ভোগ লাগব হবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দিক নির্দেশ বাংলাদেশ পুরো বিশ্বে প্রসংসিত হচ্ছে। উদ্বোধনকালে আরও বক্তব্য রাখেন পাসপোর্টের মহাপরিচাল মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার, সিলেটের জেলা প্রশাসক মো.মজিবর রহমান, সুরক্ষা বিভাগের সচিব আব্দুল¬াহ আল মাসুদ, সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান।