বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে শ্রমিকরা মজুরিতে পিছিয়ে ॥ বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে ৩২ লাখ শ্রমিক কর্মরত ॥ তাদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৭৫.৫ ডলার বা ৮, ০০০ টাকা

12
SAMSUNG DIGITAL CAMERA

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত ও রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। রপ্তানি আয়ের ৮২%-ই আসে এই খাত থেকে। সংকটের মধ্যেও গত ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ে যে রেকর্ড হয়েছে তার অবদান পোশাকখাতের।
কিন্তু পোশাক খাতের প্রাণ শ্রমিকেরা কেমন আছেন? তারা কেমন মজুরি পান?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক কম। ভারতে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২, ১৬০ টাকা (১২৮ ডলার) আর বাংলাদেশে ৮, ০০০ টাকা (৭৫.৫ ডলার, প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসেবে)।
বিলসের গবেষণা বলছে, তুরস্কে তৈরি পোশাক খাতে মোট শ্রমিক ৪০ লাখ। শ্রমিকেরা প্রতি ঘন্টায় মজুরি পান ১.৪৮ ডলার। মাসিক ন্যূনতম মজুরি পায় ৩০৭ ডলার। বাংলাদেশি টাকার ২৯, ১৬৫ টাকা। ভিয়েতনামে কাজ করে ২৫ লাখ শ্রমিক। মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১৬৮ ডলার বা ১৫, ৯৬০ টাকা। ফিলিপাইনে কাজ করে সাড়ে ৫ লাখ শ্রমিক। তাদের ন্যুনতম মাসিক মজুরি ২৪৪ ডলার বা ২৩, ১৮০ টাকা। মালয়েশিয়ায় কাজ করে দুই লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক। মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২৭০ ডলার বা ২৫, ৯৩৫ টাকা। কম্বোডিয়ায় ছয় লাখ শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১৯৪ ডলার বা ১৮, ৪৩০ টাকা। ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করে ৪২ লাখ শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১৩৭ ডলার বা ১৩, ০১৫ টাকা। ভারতে কাজ করে চার কোটি ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক। ন্যূনতম মজুরি ১২৮ ডলার বা ১২, ১৬০ টাকা। চীনে শ্রমিক এক কোটি ৫০ লাখ। ন্যূনতম মজুরি ২৬২ ডলার বা ২৪, ৮৯০ টাকা।
বিলসের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে ৩২ লাখ শ্রমিক কর্মরত। তাদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৭৫.৫ ডলার বা ৮, ০০০ টাকা।
বিলসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০২ ডলার বা ২১, ৪১৫ টাকা করার সুপারিশ জানানো হয়েছে।
বিলস মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন মজুরি প্রস্তাব করছে। তারা দেখিয়েছে, ঢাকায় চারজনের একটি শ্রমিক পরিবারে মাসিক খাবার বাবদ খরচ হয় ১৪, ৩৩০ টাকা, ঘরভাড়া ১০, ০০০ টাকা, খাবার ও ভাড়া বহির্ভূত ব্যয় ৭, ৪৪৯ টাকা, চিকিৎসা ব্যয় ১, ২৮৭ টাকা, শিক্ষা ব্যয় ১, ২৫৬ টাকা, পোশাকসহ অন্যান্য বয় ৪, ৯০৬ টাকা এবং মাসিক সেভিংস ১, ৫৮৯ টাকা। সব মিলে দাঁড়ায় ৩৩, ৩৬৮ টাকা।
পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশ পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী দুজনই একই পেশায় নিয়োজিত। সে কারণে গড়ে ১.৪৬ জন উপার্জনক্ষম ধরে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি হয় ২২, ৮৫৫ টাকা। আর বিলসের গবেষণায় যা প্রস্তাব করা হয়েছে ২২, ৮৫০ টাকা। প্রায় একই হারে ঢাকার আশপাশের উপশহর এবং চট্টগ্রামেও মজুরি কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিলসের পরিচালক (রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট) নাজমা ইয়াসমিন বলেন, “আমাদের গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে। আনুষ্ঠনিকভাবে আমরা ১৫ তারিখের মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করব।”
তার কথা, “আমরা গবেষণায় দেখতে পেয়েছি বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি অনেক দেশের চেয়ে কম। প্রতিবেশি দেশের তুলনায়ও কম। তাই আমরা তাদের মজুরি বাড়ানোরও সুপারিশ করছি।”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, “এখন পোশাক শ্রমিকদের যে ন্যূনতম মজুরি তাতে তাদের মাসের ১০ দিন সংসার চালানোই কঠিন। সংসার চালাতে গিয়ে তারা এনজিওর ঋণের জালে বন্দি হয়ে পড়ছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। অনেকে আগে যারা কষ্ট করে ঘরের জন্য ফ্রিজ বা টেলিভিশন কিনেছেন তা বিক্রি করে দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও বিক্রি করে দিচ্ছেন। ঠিকমত খাবার না পেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।”
তিনি জানান, “চার বছর আগে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮, ০০০ টাকা। এখন পাঁচ বছর চলছে। ২ জানুয়ারি আমরা সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত মজুরি বোর্ড গঠন করে ২২, ০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছি। মূল বেতন হতে হবে এর ৬৫%। আমরা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে এটা করা না হলে আমারা মাঠে আন্দোলন শুরু করব। আমরা আমাদের দাবির কথা লিখিতভাবে সরকার এবং বিজিএমইএকে জানিয়েছি।”
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “গত চার বছরে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়নি এটা ঠিক নয়। সর্বশেষ মজুরি বোর্ড বেতন বাড়ানোর পর প্রতি বছরই তাদের শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে। তারা এখন বেতন বাড়ানোর দাবি করছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। অবশ্যই আমরা মজুরি বাড়াবো। তবে তা আমাদের সক্ষমতার মধ্যে। সবাইকে পরিস্থিতি বুঝতে হবে।”
তিনি বলেন, “পোশাকখাতে গত তিন মাস ধরে অর্ডার কমে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় বাড়ার কারণ হলো ইউনিট প্রাইস বেড়ে যাওয়া। অর্ডার কিন্তু কমছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।”
তার কথা, “পোশাকখাতে আগামী এক বছর নতুন কোনো কর্মসংস্থান হবে না। আমরা চেষ্টা করছি যারা আছেন তাদের ধরে রাখতে। তবে যদি অনেক বেশি বেতনের চাপ দেয়া হয় তাহলে কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে। চলতি বছরে বেশ কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সব দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্ডার বাড়িয়ে পোশাকখাতকে টিকিয়ে রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”