সাক্ষীর আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় খালাস পাচ্ছে মানব পাচার মামলার আসামীরা \ জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাতেও সাক্ষীর হদিস নেই \ মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বিচারপ্রার্থীরা \

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভিবাসন খাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৭২ মিলিয়ন মানুষ কাজের জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে নিজ দেশে বাস না করে অন্য দেশে বাস করছেন। কাজের জন্য অন্য দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন দেশের অনেক রেমিট্যান্সযোদ্ধা। সবকিছু হারিয়ে দেশে এসে তারা নেন আইনের আশ্রয়। প্রতারকদের বিরুদ্ধে করেন মানবপাচার আইনে মামলা।
মানবপাচার আইনের মামলার সাক্ষীর সমনগুলো যখন আদালত থেকে আমাদের কাছে পাঠানো হয় সেটা আমরা নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দেই। নির্ধারিত ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে সাক্ষীর সুরক্ষা আইনের ব্যবস্থা না থাকায় সাক্ষীরা অধিকাংশ সময় সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসা নিরাপদ মনে করেন না। তাই সাক্ষী সুরক্ষা আইনের ব্যবস্থা করতে হবে।
মামলায় প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়ে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলা প্রমাণের জন্য করা হয় একাধিক সাক্ষী। কিন্তু মামলার সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তাদের আদালতে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় আসামিদের দেওয়া হচ্ছে খালাস। এতে করে মানবপাচারকারী অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন অপরাধীরা।
মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রæত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০২৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ৯১২টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছেন ৮৩ মামলার আসামিরা। আর সাজা হয়েছে ৩১টি মামলার আসামিদের। অধিকাংশ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে বার বার সমন জারি করা হয়। এরপর তাদের জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন না।
পুলিশ বলছে, নির্ধারিত ঠিকানায় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাদের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করা যায় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৫১৪ মামলার আসামিরা। ২০২১ সালের মোট ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৩৬১ মামলার আসামিরা। ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তি হওয়া কোনো মামলায় সাজা হয়নি। বরং সবাই খালাস পেয়েছেন।
অধিকাংশ মামলার খালাসের রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাক্ষী উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষের অনুরূপ ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো আইনগত বা যুক্তিসংগত বিধান নেই। মামলার বিচারে অনুরূপ বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই আসামিদের খালাস প্রদান করা ন্যায়সংগত এবং যুক্তিযুক্ত।
প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলেও শেষ পর্যায়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রপক্ষ
আসামি করা হয় বার্সেলোনা ওভারসিজ প্রা. লিমিটেডেরর ব্যবসায়িক অংশীদার জাহাঙ্গীর আলম, আসাদ, প্রোপ্রাইটর আব্দুল হালিম, প্রসেসিং ম্যানেজার মিজানুর রহমান, মনির হোসেন ও অফিসের পিয়ন মানিকে।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি প্রমাণের জন্য পাঁচজন সাক্ষী করা হয়। একই বছরের ৩ ফেব্রæয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। কিন্তু অভিযোগ গঠনের চার বছরেরও অধিক সময় অতিক্রম হওয়ার পর আদালতে কোনো সাক্ষী উপস্থিত হয়নি। আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর আসামিদের খালাস প্রদান করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এরই মধ্যে প্রায় চার বছরেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সাক্ষী উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষের অনুরূপ ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো অইনগত বা যুক্তিসংগত বিধান নেই। মামলার বিচারে অনুরূপ বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ ধারা মতে আসামিদের খালাস প্রদান করা ন্যায়সংগত এবং যুক্তিযুক্ত। শুধু শফিকুল বা পলি নন। এভাবে মানবপাচারকারীদের হাতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক রেমিট্যান্সযোদ্ধা। দেশে এসে নিচ্ছন আইনের আশ্রয়। মামলা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় খালাস পেয়ে যাচ্ছেন মানবপাচারকারী অপরাধীরা।
এ বিষয়ে ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, মানবপাচার মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে সমন জারি করেন আদালত। সমন জারির পরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না। মামলার বাদী ও সাক্ষীদের যে ঠিকানায় সমন পাঠানো হয় সে ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায় না। সাক্ষী ছাড়া মামলা প্রমাণ করা যায় না। তাই অধিকাংশ মানবপাচার মামলার আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে এ মামলাগুলোর বিচার হতো নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে। সেখান ৯৯ শতাংশ মামলা হলো পিটিশন মামলা। এ মামলাগুলোতে বাদী ও সাক্ষী হতো পাবলিক। কিন্তু তারাও একটা পর্যায়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয় না। এছাড়া কিছু মামলার বাদী হচ্ছে পুলিশ। তারাও সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হয় না। অধিকাংশ পুরোনো মামলায় বর্তমানে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আসামিদের খালাস প্রদান করছেন আদালত।
আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান বলেন, মানবপাচার দেশের জন্য অভিশাপ। মানবপাচারকে নির্মূল করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষকে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে আরও শক্তিশালী ভ‚মিকা নিতে হবে। সাক্ষীদের আদালতে আনার জন্য ভ‚মিকা নিতে হবে। সাক্ষীদের সঙ্গে মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ অথবা সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। সাক্ষীর আগের দিনও তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। যাতে করে তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হলে মানবপাচার অনেকটাই কমে আসবে।