এক যুগ পর সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী হত্যার রায় ঘোষণা ॥ ৬ আসামীর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড

11

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেটে বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি, লেখক ও গবেষক সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী হত্যা মামালার এক যুগ পর ৬ ছিনতাইকারীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামীকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে এ রায় ঘোষণা করেন সিলেটের বিশেষ জেলা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস। ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস এম আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছে, সুনামগঞ্জ সদর থানার মঙ্গলকাটা বাজার এলাকার দুর্লভপুর গ্রামের হানিফ মিয়ার পুত্র বর্তমানে নগরীর ইলাশকান্দি আলতু মিয়ার কলোনির বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন উরফে টাইগার সাদ্দাম (২২), জৈন্তাপুর থানার আদর্শগ্রামের হাবিবুর রহমানের পুত্র মো. কাশেম আলী (২২), সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর থানার আমতলী গ্রামের রাজন মিয়ার পুত্র বর্তমানে শাহপরাণ থানার টুলটিকর এলাকার বাসিন্দা সুমন (২২), নগরীর আরামবাগ ১৩ নম্বর বাসার সিরাজ মিয়ার পুত্র স্বপন মিয়া (২৫), কিশোরগঞ্জ সদর থানার নগুয়া গ্রামের আজিজুর রহমান উরফে আব্দুল আজিজের পুত্র বর্তমানে শাহপরাণ থানার বটেরতল বাবু মিয়ার কলোনির বাসিন্দা মো. ফয়ছল আহমদ রাসেল (২৩) ও সুনামগঞ্জ জেলার দিরাইয়ের ভাটিপাড়ার (গণকা) জাহান নুরের পুত্র বর্তমানে উত্তর বালুচর আল-ইসলাহর বাসিন্দা শাহ আলম (২৪)। রায় ঘোষণার সময় শুধু দন্ডপ্রাপ্ত আসামী মো: কাশেম আলী আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। অপর দন্ডপ্রাপ্ত আসামী সাদ্দাম, সুমন, স্বপন, রাসেল ও শাহ আলম পলাতক রয়েছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানী তার বন্ধু নগরীর লন্ডনী রোডের অগ্রণী ৩২ নং বাসার মৃত এরশাদ আলী পুত্র আব্দুল মালেককে নিয়ে সিলেট-হ-১১-২৮৭৫ নং মোটর সাইকেলে (ইমা-৮০সিসি) সাথে বাসায় ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে নগরীর শাহী ঈদগাহস্থ শাহ মীর (র:) মাজারের সামনের রাস্তায় পৌছামাত্র ৮ থেকে ১০ জন শস্ত্র ছিনতাইকারী তাদের গতিরোধ করে। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাদের দু’জনকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে জোরপূর্বক ফতেহ ওসমানীর সাইট ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে চাকু দিয়ে ডান উরু ও বাম বুকে এলোপাতাড়ি ৩টি আঘাত করে এবং কুপিয়ে তাকে গুরুতর আহত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তার বন্ধু আব্দুল মালেক এতে বাধা দিলে তাকেও ছিনতাইকারীরা পিটে ও উরুতে কুপিয়ে আহত করলে তার শোর চিৎকারে আসামীরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এদিকে সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানীর অবস্থা অবনতি হলে তাকে ১৯ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পি.জি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পি.জি হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হলে ফতেহ্ ওসমানীকে ঢাকার ব্যয়বহুল এপ্যোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরিবার পরিজনদের প্রচেষ্টা,সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ীদের নিরন্তর শুভকামনা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। এদিকে তার বন্ধু আব্দুল মালেক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেন। এ ঘটনায় নিহত ফতেহ্ ওসমানীর ছোট ভাই আল-ফরহাদ মতিন বাদি হয়ে ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসী সাদ্দাম উরফে টাইগার সাদ্দাম ও কাশেমের নাম উল্লেখ্য করে অজ্ঞাতনামা আরো ৮/১০ জনকে আসামী করে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। যার নং-৯৯ (২১-০৪-২০১০)
নিহত ফতেহ্ ওসমানী (৫১) নগরীর পূর্ব চৌকিদেখী আ/এ রংধনু ১৩৩/৩ নং বাসার মৃত মোজাফ্ফর আলীর পুত্র। ফতেহ্ ওসমানী আশির দশকে সিলেটের প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক জালালাবাদী পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ফতেহ ওসমানী একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘লন্ডনের সুখ দুঃখ’, ‘প্রবাসীদের দিনকাল’। যুক্তরাজ্য সফর শেষে তিনি সর্বশেষ ‘লন্ডন’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। ‘একুশের ছড়া’ নামে তাঁর একটি ছড়াগ্রন্থ ছিলো।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে এয়ারপোর্ট থানার এসআই মো: আ: আলীম উল্লেখিত ৬ আসামীকে অভিযুক্ত করে ৩৯৬ ধারায় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই আদালতে (অভিযোগপত্র নং-২৪৩) সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। এর পর উল্লেখিত ওই ৬ আসামীকে অভিযুক্ত করে ২০১৩ সালের ২১ মে চার্জগঠন করে আদালত এ মামলার বিচারকার্য্য শুরু করেন। দীর্ঘ শুনানাী ও ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গতকাল সোমবার ৩১ অক্টোবর আদালত আসামী মো: কাশেম আলী, টাইগার সাদ্দাম, সুমন, স্বপন, রাসেল ও শাহ আলীকে ৩৯৬ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।
মামলার বাদি নিহত ফতেহ ওসমানীর ছোট ভাই আল-ফরহাদ মতিন জানান, মামলা চালাতে গিয়ে এই ১২ বছরে অনেক কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে হয়েছে। তিনি বলেন, গতকাল রায়ে ৬ আসামীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হওয়ায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। এ রায়টি যেন উচ্চ আদালতে বহাল থাকে। পাশাপাশি এই মামলায় যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদেরকে বিশেষ ভাবে রাষ্ট্রপক্ষের সকল কৌঁসলীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
রায় ঘোষণা হওয়ার পর সিলেটের বিশেষ জেলা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের পিপি মো: মফর আলী বলেন, গতকাল ওই আদালতে এ মামলার রায় ঘোষনার তারিখ নির্ধারণ ছিলো। আসামী মো: কাশেম আলী, টাইগার সাদ্দাম, সুমন, স্বপন, রাসেল ও শাহ আলীকে ৩৯৬ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।