ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ৯০ কিলোমিটার

21

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। সন্ধ্যার পর সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এটি উপকূলে পৌঁছায়। রাত ১২টার পর থেকে সকাল ৬টার মধ্যে সিত্রাংয়ের কেন্দ্র বাংলাদেশের স্থলভাগে উঠে আসে। রাত ৩টার দিকে মূল কেন্দ্রটা বাংলাদেশ অতিক্রম করে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, সিত্রাং স্থলভাগে আঘাত করার সময় এর বাতাসের গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার ছিল। তবে কোনোভাবেই এটি ১০০ কিলোমিটার অতিক্রম করেনি। এটা পুরোপুরি বাংলাদেশ ভূখন্ডে আঘাত হানে। ভারতের কোনো অংশে আঘাত করেনি।
উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ১০০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হেনেছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। মাঝেমাঝে গতিবেগ পৌঁছেছিল ১১০ কিলোমিটারে। হিমশিম খেতে হয়েছিল মানুষকে। তবে ইয়াসের চেয়ে কম গতিতেই সিত্রাং আঘাত হানে বাংলাদেশে।
সিত্রাং আঘাত হানে মূলত সাতক্ষীরা উপকূল থেকে বরিশাল উপকূলে। প্রথম অংশ সন্ধ্যার পর আঘাত হানার পর উপকূলজুড়ে জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। চট্টগ্রাম, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, ফেনীর নিকটবর্তী দ্বীপ ও চরে পাঁচ থেকে আট ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। আর সিত্রাং অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম উপকূলে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিমি বেগে দমকা হাওয়া বয়ে যায়।
সিত্রাং মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিমূলক সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করছেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিত্রাংয়ে একজন মানুষও যেন মারা না যায়, সে লক্ষ্যে সকল ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সিত্রাংয়ের আঘাত থেকে বাঁচাতে ১৩ জেলার উপকূলের বাসিন্দাদের সাইক্লোন শেলটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মানুষকে সতর্ক করতে উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করা হয়। ইতোমধ্যে সরকারের মানবিক সহায়তাও উপকূলীয় এলাকায় পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এ ছাড়া দুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযান (লঞ্চ) চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চ সোমবার বেলা ১১টার পর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। একই কারণে সন্ধ্যা থেকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের তিন বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর।
নদীতে স্রোত বেশি থাকায় বিকেলের দিকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে উপকূল অঞ্চলে সাত জেলা এখন বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ভোলাসহ সাতটি সমিতিরই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।
ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্দরের জাহাজগুলোতে গভীর সমুদ্রে নোঙর করা হয়েছে। সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে বন্দরের যন্ত্রপাতিগুলো।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রায় সারাদেশে বৃষ্টি হচ্ছে। রবিবার রাত থেকেই বইছে ঝড়ো হাওয়া। সেই সঙ্গে বৃষ্টি। সকাল থেকে বইছে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। কোথাও কোথাও হচ্ছে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি। সকাল থেকে ঢাকার আকাশ মেঘে ঢাকা, হচ্ছে টানা বৃষ্টি। উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’-এর প্রভাবে দেশের সাত বিভাগেই অতিভারি বৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর জাহাজশূন্য : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হানার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বন্দর জেটি থেকে সব ধরনের জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বন্দর চ্যানেল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সব ধরনের লাইটার জাহাজও। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্দরের সব ধরনের অপারেশন। সকাল থেকে বন্দর জেটিগুলোতে পণ্য ওঠা-নামার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
তবে সকালে যে সব ট্রাক আমদানি পণ্য নেওয়ার জন্য বন্দরে প্রবেশ করেছে, শুধুমাত্র সে সব ট্রাকে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়। বিকেল ৫টার পর থেকে ওই কাজও বন্ধ হয়ে যায়।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা সংকেত অনুযায়ী বন্দরের নিজস্ব সংকেত-থ্রি জারি করা হয়েছে। এর ফলে জাহাজে কন্টেনার ওঠা-নামা, বন্দর অভ্যন্তরে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে গেছে। সব ধরনের অপারেশনাল যন্ত্রপাতি নিরাপদে রাখা হয়েছে।
সোমবার সকাল ৮টা থেকে বন্দরের সব জেটি জাহাজশূন্য করার কাজ শুরু হয়। দুপুর ১২টার মধ্যে সব জেটি থেকে জাহাজ সরিয়ে বহির্নোঙরে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দর সচিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হানার আশঙ্কায় জেটির সব জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্দরের সব ধরনের অপারেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘জেটিতে থাকা ১৮টি জাহাজ সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যে গভীর সাগরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বহির্নোঙরে থাকা ৪৬টি জাহাজকে গভীর সাগরে চলে যেতে বলা হয়েছে।’
তিনি জানান, বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব সতর্কতা হিসেবে অ্যালার্ট তিন দেখিয়েছে। এটি তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবিষয়ক সতর্কতা। আর বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ছয় নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়েছে।
লঞ্চ চলাচল বন্ধ : সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করায় অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক (নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দুপুর থেকে যাত্রীবাহীসহ সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।’
পদ্মা নদীতে উত্তাল ঢেউয়ের কারণে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। পাটুরিয়া লঞ্চ ঘাটের ব্যবস্থাপক পান্না লাল নন্দী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঘাট এলাকায় সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস বেড়ে যাওয়ায় নদীতে উত্তাল ঢেউ তৈরি হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সকাল ১১টা থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া নৌপথে ২০টি ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ১৩টি লঞ্চ রয়েছে।
তবে, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ১৭টি ফেরির মধ্যে ১১টি এবং আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে পাঁচটি ফেরির সবকটিই চলাচল করছে। নদী উত্তাল ও স্রোত থাকায় ফেরি পারাপারে বেশি সময় লাগছে। ঘাট এলাকায় পর্যাপ্ত ফেরি থাকলেও যানবাহনের কোনো চাপ নেই। তবে, নদীতে স্রোত ও উত্তাল হাওয়া বেড়ে গেলে ফেরি চলাচলও বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
একই কারণে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চের দুর্ঘটনা এড়াতে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে চাঁদপুর লঞ্চ ঘাটের সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লঞ্চ চলাচল চালু হবে বলে জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের ৯ কন্ট্রোল রুম : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সদর দপ্তরসহ বিভাগভিত্তিক নয়টি অফিসে কন্ট্রোল রুম খুলেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে সারাদেশে ৪৯০টি ফায়ার স্টেশনকে বাড়তি মেসেজ দেওয়া হয়েছে। সোমবার সকাল থেকেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঝড়ের প্রভাবে গাছ উপড়ে পড়াসহ ভারি বর্ষণের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষ। তাদের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা সকাল থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন।
সোমবার বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ সব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সদর দপ্তরসহ ডিভিশনভিত্তিক নয়টি কন্ট্রোল রুম খুলেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এ ছাড়া দেশের ৪৯০টি ফায়ার স্টেশনকে বাড়তি মেসেজ দেওয়া হয়েছে। দেশের সর্বত্রই ফায়ার সার্ভিস কোনো না কোনো সংবাদ পেয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এই ঝড়ের প্রভাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু করেছে। কোথাও গাছ উপড়ে পড়েছে, কোথাও অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে ঝড়ের কারণে। খবর পেয়ে দ্রুতই সেখানে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ছুটে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সদর দপ্তরসহ ডিভিশনভিত্তিক নয়টি কন্ট্রোল রুম করা হয়েছে। যেখানেই সংবাদ পাচ্ছে, সেখানেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছুটে যাচ্ছেন।