মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক শ্রমবাজার নির্ভরতা কাটাতে চায় বাংলাদেশ। করোনা পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা চললেও ইউরোপের শ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এজন্য দক্ষ শ্রমশক্তি রফতানির সক্ষমতা বাড়িয়ে দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দক্ষ, আধাদক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠিয়ে অধিক হারে রেমিটেন্স আহরণের লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা কাটাতে ইতোমধ্যেই মলদোভা, সার্বিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও রোমানিয়ায় অল্পসংখ্যক আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়েছে। এছাড়া দেশগুলোও বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী নিতে আগ্রহী এবং সেভাবেই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে বলে জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বৈধ পথে ইউরোপের দেশ গ্রিস, মাল্টা, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া ও মাল্টায় কর্মী পাঠাতে চায় সরকার। রোমানিয়ায় ইতোমধ্যে ৫ হাজারের বেশি মুলতবি ও নতুন ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। এর আগে দীর্ঘদিন সেখানে কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল। এছাড়া ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করা হচ্ছে, দেশগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন হলে বিপুলসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান হবে। করোনা পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে ভাটা সৃষ্টি করেছে।
মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, বলকান অঞ্চল ও পূর্ব এশিয়ার নতুন কিছু দেশে শ্রমিক রফতানির সম্ভাবনা খুঁজে দেখা হচ্ছে। এছাড়া গ্রিস, আলবেনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকংয়ের কথাও ভাবা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, এসব দেশে কর্মী পাঠানোর পর কর্মীরা ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে অবৈধভাবে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সে জন্য খুব হিসাব করেই সামনে এগোচ্ছে ঢাকা।
কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো অবৈধ অভিবাসনের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আর বাংলাদেশও চায় না কোন নাগরিক অবৈধভাবে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমাক। কারণ অতীতে ইতালিসহ ইউরোপের অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ ছিল। রোমানিয়ার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছিল। অতীতে সেখান থেকে শ্রমিকরা পালিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে পাড়ি জমাত। অথচ সফলতার সঙ্গে রোমানিয়াতেই তিন বছর কাটিয়ে দিলে রোমানিয়া থেকে বৈধ পথে তার ইতালিসহ অন্য দেশে যাওয়ার সুযোগ মিলত। মূলত শ্রমিকদের ওই দেশের আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এমনটি ঘটেছে। তাই নতুন করে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে।
মলদোভায় শ্রমিক যাচ্ছে : মলদোভায় বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে তারা বাংলাদেশী শ্রমিক নিতে রাজি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। শনিবার এক বার্তায় ড. মোমেন আরও জানিয়েছেন, প্রথম ব্যাচে ২৮ বাংলাদেশীকে মলদোভার ভিসা দেয়া হয়। তারা এ্যালুমিনিয়ামের জানালা তৈরির কারখানায় কাজ করবেন। আরও ৪০ জনের ভিসা পাইপলাইনে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল মলদোভা। নতুন করে ভিসা দেয়া শুরু করায় দেশটিতে শ্রমিকদের যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
রোমানিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যাম সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে ২০২১ সালের অক্টোবরের শুরুতে রোমানিয়াতেও যান। তার ওই সফরে দেশটিতে ৪০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। তখন মোমেন বলেন, রোমানিয়া সরকারের সঙ্গে জনশক্তি রফতানি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা বিভিন্ন খাতে ৪০ হাজার শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
এর মধ্যে মে, জুন ও জুলাই মাসে সেখানে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজে যান। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪শ’ মুলতবি ভিসা ছিল। আর বাকিটা নতুন ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। বাংলাদেশে রোমানিয়ার স্থায়ী দূতাবাস না থাকায় ভিসার জন্য শ্রমিকদের ভারতে যেতে হতো। তাই রোমানিয়া সরকার ভিসা জটিলতা কাটাতে বাংলাদেশে তিন মাসের জন্য কনস্যুলার অফিস খুলেছিল। রোমানিয়া সরকার মার্চ মাসে ভিসা ইস্যুর জন্য ৬ সদস্যের একটি কনস্যুলার টিম ঢাকা পাঠায়।
গার্মেন্টস কর্মী নিচ্ছে বুলগেরিয়া : ভাল বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়া। এই প্রথম ইউরোপের কোন দেশে পেশাগত যাত্রা শুরু করছেন বাংলাদেশের আরএমজি কর্মীরা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এই প্রথম ইউরোপের কোন দেশ বাংলাদেশ থেকে আরএমজি কর্মী নিয়োগের জন্য আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিল।
ফারুক হাসান আরও বলেন, আমরা মনে করি প্রত্যেকেরই উন্নত জীবন বেছে নেয়ার অধিকার আছে। বুলগেরিয়ার কারখানায় কাজের প্রস্তাব শ্রমিকদের ভাল জীবনযাপনে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আরও বেশিসংখ্যক লোককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। অবশ্য ইংল্যান্ডের কিছু পোশাক কারখানায় অল্পসংখ্যক বাংলাদেশী কাজ করছেন বলে জানান তিনি। প্রাথমিকভাবে দুটি বুলগেরীয় কোম্পানি আঁতোয়া ভিল ও মিজিয়া-৯৬এডি প্রতি মাসে ৪৬০ ডলার (৪৫,০০০ টাকা) বেতনে ১০০ কর্মী নিয়োগ করছে। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসল) তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শ্রমিক নিতে চায় সার্বিয়া : ২০২১ সালের অক্টোবরের শুরুতেই বেলগ্রেড সফরে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার ভুসিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় ভুসিক বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মী নেয়ার বিষয়ে আগ্রহের কথা জানান। এ জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া তৈরিতে জোর দেন তিনি। পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সার্বিয়ার চলমান উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য যে বিপুল মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা পূরণে বাংলাদেশের দক্ষ ও আধাদক্ষ আইটি পেশাজীবী, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বারদের (কলমিস্ত্রি) অনেক চাহিদা রয়েছে। আমি তাই বাংলাদেশ থেকে চাহিদা পূরণের প্রস্তাব দিই। এ প্রস্তাব সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট সাদরে গ্রহণ করেন।
নতুন শ্রমবাজার কোথায়? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি জাতীয় সংসদকে জানান, দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এর বাইরেও বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
তবে সেখানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক রফতানি কমেনি। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে মন্দাবস্থা দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের বাজার সামনে কিছুটা খারাপ হতে পারে। এ জন্য বিকল্প বাজার হিসেবে ইউরোপকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো দক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিকের ওপর গুরুত্ব দেয়। এতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বেতনও বেশি পাবেন তারা।
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মোঃ শহীদুল আলম এনডিসি জানান, নতুন যেসব দেশে সরকার শ্রমবাজারের সম্ভাবনা দেখছে, তার মধ্যে ইউরোপ ছাড়াও মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া রয়েছে। তিনি বলেন, মরুভূমির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তা ছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরন ভাল, শুধু ক্লিনারের কাজ না। বেতনও বেশি, আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভাল।
বেসরকারী সংস্থা রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি বলেন, ২০২৫ সাল নাগাদ জাপান সারা বিশ্ব থেকে ৫ লাখ কর্মী নেবেন। বাংলাদেশকে এই বাজার ধরতে হবে। যারা জাপানী ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে, তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
ভাষা ও দক্ষতায় বেশি লাভ : নতুন গন্তব্যের দেশগুলোতে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি শেখা নির্দিষ্ট কাজের বিশেষ দক্ষতা ওই কর্মীকে বেশি লাভবান করবে বলে মতামত বিশেষজ্ঞদের। সেই সঙ্গে জানতে হবে ইংরেজী ভাষাও।
ড. তাসনিম সিদ্দিকির বক্তব্য অনুসারে, কোন দেশে যাওয়ার আগে কেবল দুই-তিন মাসের কোর্স করে কখনই বাজার ধরা যাবে না। সে জন্য স্কুল পর্যায় থেকেই অন্যান্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানো দরকার। বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা যেমন- ওয়েলডিং, ইলেকট্রনিক সামগ্রী মেরামত, গাড়ি মেরামত, বৈদ্যুতিক কাজ- এসব কাজের শিক্ষা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, নার্স ও ল্যাব টেকনিশিয়ান তৈরিতে বেসরকারী খাতের সঙ্গে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। কৃষি কাজে যোগ দিতে হলে কৃষি যন্ত্রপাতি, গাছের আধুনিক উপায়ে পরিচর্যা, গাছ ও তার মৌসুম সম্পর্কে শিখতে হবে।
ইউরোপে বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ নেই : প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, আমাদের দেশ থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপে বৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে কৃষি শ্রমিকসহ যারা যান, তারা একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান। আমরা চেষ্টা করছি, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এমওইউ করার, যাতে আমাদের শ্রমিকদের এখান থেকে বৈধভাবে পাঠাতে পারি।
‘ইউরোপে একটা সুবিধা আছে, ওখানে ইংরেজী মোটামুটি প্রচলিত। যে চাহিদা এই মুহূর্তে ইউরোপে আছে, নার্সসহ বিভিন্ন সেক্টরে, সেখানে কিন্তু যারা যাবে তাদের মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, ফলে ভাষাটা ভালভাবে শিখে যেতে হবে। সেই হিসেবে আমরা ইউরোপের কয়েকটি দেশের ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি এবং এর সঙ্গে ইউরোপের চাহিদা মোতাবেক সার্টিফিকেশন, এটা যদি আমরা এখান থেকে দিতে পারি এবং সেটা ওখানে যদি গ্রহণযোগ্য হয়, এমন উদ্যোগও কিন্তু আমরা হাতে নিয়েছি।’