কৌশল পাল্টে মানব পাচার হচ্ছে ফেসবুক, টিকটক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপে ॥ দেশ-বিদেশের ১৮ চক্র জড়িত

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানব পাচারে কৌশল পাল্টেছে পাচারকারী চক্র। এজন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টিকটক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের আশ্রয় নিচ্ছে। এক সময়ে পরিচিতদের মাধ্যমে বা সরাসরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফুঁসলিয়ে বা লোভ দেখিয়ে করা হতো মানব পাচার। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে এ কাজ করছে পাচারকারীরা। বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৮টি রুটে মানবপাচার হচ্ছে বিদেশে। এজন্য পাচারকারীরা বেছে নিচ্ছে ভূমধ্যসাগরের মতো মৃত্যুকূপ। তাদের মাধ্যমে গত ৭ বছরে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়েছে প্রায় ২০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। এ সময়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌযান ডুবে ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুসারে, কেবল ২০২১ সালে ভূমধ্যসাগরে প্রায় ২ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪০১। ভূমধ্যসাগর দিয়ে যেসব দেশের মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তালিকার শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশের নাম।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, সারাদেশের অন্তত ১৫ জেলায় মানব পাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত দেশী-বিদেশী ১৮ চক্র। এর মধ্যে দেশের ভেতরে ১৪ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৩ শতাধিক। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার কাজে লিবিয়ায় সক্রিয় আছে আরও ৪ চক্র। এই ১৮ চক্র মিলে লিবিয়া হয়ে ইতালি-ইউরোপে মানব পাচার করছে দেশী-বিদেশী চক্র। মানব পাচারকারী চক্রের ১৩৫ সদস্য পলাতক। মানব পাচারকারী চক্রের পলাতক সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে সিআইডি।
অভিবাসন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ৫,০০০ মানুষ বাংলাদেশ থেকে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে। ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে মানুষ। সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগর থেকে গত ১৪ মে উদ্ধার হয়েছে ৩২ বাংলাদেশী। এটি আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। ওইদিন ৩২ বাংলাদেশীসহ ৮১ অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মাদারীপুর জেলার একজন বাসিন্দা। স্থানীয় একটি কলেজে স্নাতক পড়ার সময় এই ব্যক্তি ফেসবুকে ইতালির একটি গ্রুপের সদস্য হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখান থেকে তাকে স্থানীয় একজন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এরপর তিনি ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু লিবিয়ার ত্রিপলি যাওয়ার পর একটি গ্রুপ তাকে বন্দী করে। পরবর্তীতে পরিবার আরও পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ পাঠিয়ে তাকে দেশে ফেরত নিয়ে আসে।
অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রন্টিয়ারের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, যত মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে আটক হয়েছে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় তৃতীয়। গত বছর ৭,৫৭৭ জন বাংলাদেশী ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছে। একসময় সরাসরি বা পরিচিতদের মাধ্যমে বিদেশে চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করা হলেও এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কত মানুষ পাচারের শিকার হন, তার সঠিক কোন তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তবে প্রযুক্তির উন্নতি ও ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে মানব পাচারে এখন বড় উপাদান হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ায় প্রলুব্ধ করতে ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ তৈরি করে কাজ করে পাচারচক্র। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে কোন নৌকা ইউরোপে যেতে সফল হলে সেসব ভিডিও বা ছবি এসব পেজে দিয়ে অন্যদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। টাকার লেনদেনেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমো ব্যবহার করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে অনেক সক্রিয়। সেই কারণে তারা এখানে তৎপরতা বাড়িয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিদেশে ভালো চাকরি আর নারী-শিশু কিশোরীদের পাচারের ক্ষেত্রে ভালো চাকরি, নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখানো হয়। গত ১০ বছরে শুধু ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজার নারীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একটি পাচারের ঘটনা আলোড়ন তৈরি করে। ভারতে পাচার হওয়া একজন নারী তিন মাসের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করার পর পুলিশ একটি চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করে। সেই তরুণীকে টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছিল। পরে সেখানে তাকে আটকে রেখে যৌনকর্মে বাধ্য করা এবং নির্যাতন করা হয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মাঠ পর্যায়ের গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, পাচারকারীরা অনেক বেশি সক্রিয় অনলাইনে। ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো এই সমস্ত জায়গায় যারা সক্রিয়, তাদের কাউকে কাউকে ভারতে পাচারের জন্য তারা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করছে, প্রলোভন দেখাচ্ছে, কখনও টিকটকের মডেল বানানোর কথা বলছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহায়তায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম নিয়ে একটি গবেষণা করেছে।
সেখানে তারা দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অথবা ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানব পাচারের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, ইমোসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলছেন, বিশ্বব্যাপী মানব পাচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই কারণে এই বছর জাতিসংঘ এই বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। মানব পাচারকারীরা যাতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোর মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারে, তাদের যাতে সহজে শনাক্ত করা যায় সেজন্য তারা এসব প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে বা সিআইডির অর্গানাইজ্ড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ নজরুল ইসলাম বলেছেন, প্রযুক্তির নেতিবাচক আর ইতিবাচক দুটি দিকই আছে। এখন সব অপরাধীদের মতো মানব পাচারকারীরাও প্রযুক্তির ব্যবহার খুব বেশি করছে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ বেশি হচ্ছে। অপরাধী হয়ত দেশের বাইরে আছে। তিনি ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল বা অন্য কোন মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন। তাকে ভুক্তভোগীর ফেস টু ফেস হতে হচ্ছে না। ভুক্তভোগী প্রতারিত হলেও মূল আসামিকে দেখছেন না। আবার ভাইবার, ইমো ব্যবহার করে তাকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে, খুব সহজে টার্গেট করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব পাচার, স্মাগলিং ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে আমরা সবসময়েই তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছি। এটা ব্যবহার করে আমরা আসামিদের অপরাধস্থল শনাক্ত করে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করতে পারছি। এটা আমাদের জন্যও বিশাল একটা সুযোগ তৈরি করছে। অপরাধীরা যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অপরাধী শনাক্ত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেশি বেতনের চাকরি ও উন্নত জীবনযাপনের প্রলোভনের টোপে ফেলে দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধপথে মানব পাচার করার ঘটনা দিনে-দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করার তথ্য মিলছে। দালাল চক্র সাত-আট লাখ টাকা নিয়ে জিম্মি করে ইতালি বা ইউরোপের কোন দেশে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে তুলে দেয়ার পর আটক হচ্ছে আবার দুর্ঘটনায় পড়ে উদ্ধার হচ্ছে। প্রাণ হারানোর খবর আসছে প্রায়ই।