বাজারে স্বস্তি ফেরাতে চাল ও গমের মজুদ বাড়ানো হচ্ছে

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চাল ও গমের মজুদ আরও বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতকে উৎসাহিত করতে আমদানির ওপর সমুদয় শুল্ক প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আমদানি বৃদ্ধি এবং ব্যাপকভাবে তিন কর্মসূচীতে সরকারের চাল বিক্রির ফলে বাজারে কমতে শুরু করেছে দাম। জাত ও মানভেদে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দাম কমেছে ৫-৮ টাকা পর্যন্ত। তবে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে মোটা চালের দাম আরও কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মজুদ বাড়াতে এবার থাইল্যান্ড থেকে সাড়ে চার লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আগামী বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এই প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হবে। এতে করে কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারী মজুদে খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৩০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। মূলত, বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে এবার রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, চালের দাম কমাতে খোলা বাজারে বিক্রি কার্যক্রম (ওএমএস) খাদ্যবান্ধব কর্মসচী চালু এবং টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে দেশের এই প্রধান খাদ্যপণ্যটি ভর্তুকিমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। তিন কর্মসূচীতে সরকারের এই কার্যক্রমের ফলে সরাসরি আড়াই কোটি পরিবার ভর্তুকি মূল্যের চাল কিনতে পারছেন। এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। চাল নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এখন কিছুটা কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কেজিপ্রতি মান ও জাতভেদে ৫-৮ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। দাম কমে স্বর্ণা ও চায়না ইরিখ্যাত মোটা চাল ৪৭-৫২, মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চাল ৫০-৫৮ এবং সরু নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৬২-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চালের দাম কমতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে কাপ্তান বাজারের নুরু রাইছ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী হাজী নুরু মিয়া বলেন, প্রতি সপ্তাহে চালের দাম কমছে। সরকারীভাবে চাল বিক্রি এবং সরবরাহ বাড়ায় পাইকারি বাজারেও চালের দাম কম। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঢাকার বাদামতলীর পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সব ধরনের চালে বস্তাপ্রতি ২৫০-৩৫০ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। তাদের মতে, আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা সুবিধামতো বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি বাড়িয়েছেন। এর পাশাপাশি সরকারী মজুদ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে আপাতত চালের সঙ্কট কেটে গেছে। এদিকে, চালের মজুদ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি সরকারী ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে চায় সরকার। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা রয়েছে।
এ কারণে ক্রয়-সংক্রান্ত বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল ও গম আমদানির সব ধরনের প্রস্তাবে দ্রুত অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআর চাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এসব করা হচ্ছে দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে। উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং সর্বশেষ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। ফলে দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু তিন স্তরে চাল বিক্রির নতুন এই উদ্যোগের ফলে দাম কমতে শুরু করেছে বাজারে। একইভাবে সরকারী আমদানি বাড়ানো হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ টন থাকলেও এবার সরকার ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৮০ মেট্রিক চাল সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বর্তমানে সরকারের মজুদের পরিমাণ ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ২১৬ টন, যা মজুদের দিক দিয়ে সরকারকে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া চাল ও গম মিলিয়ে আরও প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টন আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ড থেকে আরও সাড়ে ৪ লাখ টন চাল আমদানির ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়া হবে। এতে করে এবার রেকর্ড ৩০ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ হবে সরকারী গুদামে। আটা ও গমের দাম কমাতে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানি করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি ইউক্রেন থেকেও খাদ্যশস্য আমদানির চেষ্টা করছে সরকার। এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। এ লক্ষ্যে খাদ্য মজুদের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ইতোমধ্যে আমরা শতভাগ সংগ্রহ করেছি। টার্গেট পূরণের পর আগ্রহীদের নতুন করে আবার বরাদ্দ দেয়া হয়। তাও আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ চালের মজুদ রয়েছে। তারপরও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত ও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য চাল আমদানি বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশে আমন আবাদ কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। শুধু দেশে নয়, সারাবিশ্বেই খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, সরকারীভাবে প্রায় সাড়ে আট লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানির পথে রয়েছে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে এগুলো চলে আসবে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম, ভিয়েতনাম থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টন চাল এবং ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আনা হচ্ছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড থেকে আরও সাড়ে ৪ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। সে হিসাবে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে সরকারের মজুদে যোগ হবে আরও প্রায় সাড়ে ৮ লাখ থেকে সাড়ে ১২ টন খাদ্যশস্য। এ ছাড়া সম্প্রতি ৩৮০টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১০ লাখ টন চাল বেসরকারীভাবে আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বেসরকারীভাবে এই চাল আসা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার শুল্কমুক্ত চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ২৮ আগস্ট ডিজেল ও চালের আমদানি শুল্ক কমানো হয়। এতে সব ধরনের চাল আমদানির ওপর সমুদয় শুল্ক প্রত্যাহার এবং রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে, ডিজেলের আগাম কর ৫ শতাংশ প্রত্যাহার এবং আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সুবিধাটি বহাল থাকবে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া ডিজেলের দাম কমায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়বে এবং পরিবহন খরচ হ্রাস পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতিপূর্বে আগে আমদানি করা চালের শুল্ক ছিল ২৫ শতাংশ এবং সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন চালের শুল্ক থাকবে মাত্র ৫ শতাংশ। আর ডিজেল আমদানিতে মোট শুল্ক-কর ছিল ৩৪ শতাংশ। এখন ১০ শতাংশ কমানো হলো। ফলে ডিজেলের শুল্ক থাকল ২৪ শতাংশ। এনবিআর বলেছে, দেশের বৃহৎ স্বার্থে জনকল্যাণে চাল ও ডিজেলের শুল্ক-কর হার কমানো হয়েছে। এর ফলে চালের দাম কমে আসবে এবং ভোক্তা কম দামে চাল কিনে খেতে পারবে। এদিকে, ঘাটতি মেটাতে সরকার থাইল্যান্ড থেকে প্রতিটন ৫১০ থেকে ৫২০ ডলারে চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খাদ্য সচিব মোঃ ইসমাইল হোসেন জানিয়েছেন, থাইল্যান্ড থেকে মোট ৪.৫০ লাখ টন চাল আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে।