নিত্যপণ্যের বাজারে কাটছে না অস্থিরতা, প্রসাধনীতেও অস্বস্তি

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিত্যপণ্যের বাজারে কিছুতেই কাটছে না অস্থিরতা। ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে প্রায় সব পণ্যে। মাসখানেক আগে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়া নিত্যপণ্যের দামে কোনো সুখবর নেই। মুরগি, আলু ও মুগডালের দাম কেবল কমেছে। কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল। বাকি পণ্য এখনো বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। একই সময়ে প্রসাধনীর দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৩২ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে মিলেছে এমন তথ্য।
টিসিবি বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর গত এক মাসের ব্যবধানে চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পামঅয়েল), চিনি, মসুর ডাল, শুকনা মরিচ, আদা, জিরা, লবঙ্গ, এলাচ, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, গুঁড়াদুধ, লবণসহ ফার্মের ডিমের দাম বেড়েছে।
এছাড়া বাজারে স্থিতিশীল রয়েছে অ্যাংকর ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, দারুচিনি, ধনে, তেজপাতা, রুই মাছ, খাসির মাংস এবং খেজুরের দাম। কমেছে শুধু আলু, মুরগি ও মুগডালের দাম।
অন্যদিকে বাজারে কাঁচামরিচ, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ফলমূল, বেকারিপণ্যসহ নিত্যব্যবহার্য প্রায় সব প্রসাধনীর দাম বেড়েছে। সাবান, টুথপেস্ট, নারিকেল তেলসহ বিভিন্ন প্রসাধনীর দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত। আগে আধা কেজির যে ডিটারজেন্টের দাম ছিল ৬০ টাকা, সেটি এখন ৯০ টাকা। ৫২ টাকার সাবানের দামও এখন ৭৫ টাকা হয়েছে। যদিও এসব পণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব টিসিবির কাছে থাকে না।
টিসিবি বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শুকনা মরিচের দাম। গত মাসে যে মরিচের দাম ছিল ৩০০-৩৩০ টাকা, সেটা এখন ৩৫০-৪৫০ টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে খোলা আটার দাম বেড়েছে ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আগে ৪০-৪২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৪৭-৫২ টাকায় ঠেকেছে। যদিও এ সময়ে প্যাকেটজাত আটার দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।
যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে সেগুলো ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি হলেও কমার তালিকায় থাকা তিনটি পণ্যের (আলু, মুগডাল, মুরগি) দাম কমার হার যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ৬ দশমিক ১২ এবং ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে সে হারে কমছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসের ব্যবধানে শুকনো মরিচের দাম বাড়ার প্রধান কারণ ছিল কাঁচামরিচের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। গত মাসে (আগস্ট) কাঁচামরিচের কেজি ২০০ থেকে ২৬০ টাকা ছিল। সেসময় তালমিলিয়ে শুকনো মরিচের দামও বাড়ে। তবে কাঁচামরিচের তুলনায় প্রয়োজন কম হওয়ায় টের পাননি অনেকে।
অন্যদিকে প্রয়োজনীয় আটার দাম বেশি হওয়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। চালের বেশি দামের কারণে যারা প্রতিদিন অন্তত একবেলা রুটি খেয়ে খরচ কমাতে চেয়েছিলেন তারাও অসন্তুষ্ট হয়েছেন। পাশাপাশি অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে হোটেল রেস্তোরাঁয় পরোটা, রুটি, তন্দুরের দাম বেড়েছে। আগে যে পরোটা ১০ টাকায় খাওয়া যেত সেটা এখন ১৫ টাকা গুনতে হচ্ছে।
এছাড়া বাজারে এক মাসের ব্যবধানে খোলা ময়দার দাম ৮ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৬ দশমিক ৪৪, পাম তেলের দাম ১২ দশমিক ২৪, গুঁড়াদুধ ৬, চিনি ৯ দশমিক ৮৮, লবণ ১০ দশমিক ৬১, আদা ৮ দশমিক ৩৩, জিরা ১৯, লবঙ্গ ১৭ দশমিক ৭৮ এবং ইলিশ মাছের দাম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম হঠাৎ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় বেশকিছু পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানির খরচ দ্বিগুণ হয়েছে।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল চাল। এরপর তেল, চিনির মূল্যবৃদ্ধি এবং শেষে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম। পরবর্তীসময়ে সরকারের কিছু পদক্ষেপে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমেছে।
এসব বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে কোনো পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ে সেটি পরবর্তীসময়ে সেভাবে সমন্বয় হয় না। দাম কমলেও সেটা বাজারে বাস্তবায়ন করতে চান না কোম্পানি বা বিক্রেতা কেউই।
‘এ প্রবৃত্তি এখন খুব বেশি। সেগুলো ঠেকাতে দেশে বেশকিছু বিদ্যমান আইনও আছে। তবে সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই। সরকারকে এখন অত্যন্ত কঠোর হতে হবে।’
এদিকে সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের বাইরে পরিবারে ব্যবহৃত নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এসেছে। গত কয়েক সপ্তাহে অস্বাভাবিকভাবে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। সে বিষয়টি অবশ্য নজরেও এসেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। ফলে বুধবার এসব পণ্যের কারখানা পরিদর্শন করে মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা বের করার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, নিত্যব্যবহার্য পণ্য সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, লিকুইড ক্লিনারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কোম্পানিগুলো বলছে, ডলার ও কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে পণ্যের দাম আরও বাড়ানো দরকার। যদিও তারা ভোক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই পরিমাণ দাম বাড়াতে পারছেন না।
তিনি বলেন, তবে ভোক্তাদের দাবি ব্র্যান্ড-ভ্যালু আর মানুষের ইমোশন পুঁজি করে বড় কোম্পানিগুলো অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। সেজন্য কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে হলে তার পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে কোম্পানিগুলোকে। তাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা যাবো। কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে সেটা জানতে চাই। এরপর এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবো। তারপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।