চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ, কেজিতে কমবে ১০ টাকা

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চালের সমুদয় শুল্ক প্রায় প্রত্যাহার করে সরকার যথার্থ কাজই করেছে। ঊর্ধ্বগতির চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে এই পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। ইতোপূর্বে চালের ওপর আরোপিত শুল্কহার কিছুটা কমালেও তার প্রভাব বাজারে পড়েনি। ওই শুল্কে ভারত থেকে আমদানিকৃত চালের দাম দেশীয় চালের চেয়ে বেশি পড়ছিল। ফলে আমদানির অনুমতি নিয়েও ব্যবসায়ীরা দেশে চাল আমদানি করছিল না। ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতির বিপরীতে দেশে এসেছে মাত্র ৩২ হাজার টন। এই অবস্থায় বাজারে বোরো ধানের সরবরাহ কমে আসায় সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ছিল চালের দাম। ফলে সামনের দিনগুলোতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে চালের আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনা জরুরী হয়ে পড়েছিল। সরকার অতিসম্প্রতি চালের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়েই জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্যশস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে চালের আন্তর্জাতিক বাজার কোন্দিকে যায় তা বলা মুশকিল। তাই, এখন সরকারের উচিত হবে এই সুবিধায় বেসরকারী খাতে দ্রুত দেশে চালের সরবরাহ বাড়ানো, যাতে দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং সরকারী-বেসরকারী খাতে চালের বড় ধরনের মজুদ গড়ে ওঠে।
গত দুই বছর ধরেই দেশে চালের বাজার অস্থির। এর মধ্যে গত বোরো মৌসুমে দেশের হাওর অঞ্চলে ফসল ডুবে যাওয়া এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দেশের অন্যান্য স্থানে ফসল নষ্ট হওয়ায় এ বছর দেশের বোরো উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এই খবরে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াতে শুরু করে। এই অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি স্থিতিশীলতা আনতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে বেসরকারীভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চাল আমদানির শুল্ক কমানোর প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ওই দফায় চার মাসের জন্য চালের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে ১০ শতাংশে। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।
অন্যদিকে, বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে বেসরকারী উদ্যোগে চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ৩০ জুন থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে শুরুতে কিছু চাল এলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিতে ধীর গতি নেমে আসে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত মাত্র ৩২ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। ফলে বাজারে চাল সরবরাহে ঘাটতির সুযোগ নেয় একশ্রেণীর অসৎ ব্যবসায়ী। তারা সিন্ডিকেট করে মজুদ করতে শুরু করে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে চালের দাম। চালের এই মূল্য বৃদ্ধির সুযোগে ঘি ঢেলে দেয় অবিবেচকের মতো হঠাৎ করে আইএমএফের ডলার নিতে রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয় সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ফলে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে পুরো বাজার ব্যবস্থা। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে চালের বাজারে। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগে মিলার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়াতে থাকে চালের দাম। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহেও বৃদ্ধি পায় চালের দাম। এ সপ্তাহে এসে দাম বাড়ে গরিব মানুষের মোটা চালের। ফলে মোটা চালের দামই ৬০ টাকায় উঠে যায়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। লাগামহীনভাবে চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়ে স্বল্প আয়ের মানুষ। ফলে ওএমএসের চাল কিনতে ক্রেতার লাইন ক্রমেই বড় হচ্ছে।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে বাজারে চালের মূল্য ছিল- প্রতিকেজি মোটা চাল ইরি বা স্বর্ণা ৫৭ থেকে ৬০ টাকা, মাঝারিমানের চাল পাইজাম বা লতা ৫৮ থেকে ৬৪ টাকা আর সরু চাল মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৮ টাকা ও নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৮৬ টাকা।
চালের এই উচ্চ মূল্যের সঙ্গে চাল ব্যবসায়ীদের কাছে বার্তা যায় যে, বোরোর পর আমন উৎপাদনও আশানুরূপ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য হলো, গত বোরো মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৩০ শতাংশ ধান নষ্ট হয়েছে। অথচ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে। একই অবস্থা আমনের ক্ষেত্রেও। বৃষ্টির অভাবে অর্জিত হচ্ছে না আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রাও। আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। তার ওপর বিলম্বে রোপণের কারণে উৎপাদনও কমে যাবে। এসব বার্তা পেয়ে চাল ব্যবসায়ী বিশেষ করে মিলাররা চাল মজুদ শুরু করে। ফলে বাজারে চালের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে চালের দাম বাড়তে থাকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। আগে যে ট্রাক ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা; জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। এই বাড়তি ভাড়ার টাকা চালের দামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাই চালের দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া চাহিদার তুলনায় বিদ্যুত সরবরাহ কম থাকায় মিলে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এরও প্রভাব পড়েছে বাজারে। পাশাপাশি চাল মজুদের অভিযোগও পাওয়া গেছে মিলারদের বিরুদ্ধে।
এই অবস্থায় সরকার নড়েচড়ে বসে। দ্বিতীয় দফায় চালের আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের আমদানি শুল্ক আরও কমানোর জন্য গত ৭ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রস্তাব পাঠায়। এ দফায় চালের সমুদয় শুল্ককর প্রত্যাহার এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। চাল ও ডিজেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পণ্য দুটির শুল্ক এবং কর কমানো হয়েছে। এর মধ্যে চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক তুলে নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বাজারে সরবরাহ বাড়াতে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর ডিজেলের আগাম কর অব্যাহতি ও আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। গত ২৮ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। চালের বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সুগন্ধি চাল ছাড়া যে কোন চাল আমদানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে। সুবিধাটি বহাল থাকবে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শুল্ক কমানোর পদক্ষেপটি প্রথম দফায়ই করা উচিত ছিল। ওই সময় বর্তমান পর্যায়ে শুল্ক কমানো হলে চালের বাজারে এই অস্থিরতা সৃষ্টি হতো না। বিশেষজ্ঞরা এজন্য মাঠ পর্যায় থেকে বোরো উৎপাদনের ভুল তথ্য প্রদানকে দায়ী করছেন। মাঠ থেকে সঠিক তথ্য এলে নীতিনির্ধারকদের পক্ষে চালের চাহিদার বিপরীতে প্রকৃত ঘাটতির হিসাব করে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। সেই অনুযায়ী, আরও আগেই পদক্ষেপ নিতে পারতেন। এখন বিলম্বের কারণে ঘাটতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারসাজির মাধ্যমে চাল ব্যবসায়ীরা বিপুল অঙ্কের টাকা মুনাফা করে নিয়েছে। এতে ভোক্তারা শুধু দুর্ভোগেই পড়েননি, আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হয়েছেন।
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহাও বলছেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে উৎপাদন ঘাটতি। আমদানির মাধ্যমে সেটি দ্রুত পূরণ না হওয়ার সুযোগ নিয়েছে একটি মহল।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সব সময় ওঁৎ পেতে থাকে কখন সরকার তাদের সুযোগ তৈরি করে দেবে মুনাফা করার জন্য। চালের শুল্ক কমানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামও লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমানোর তামাশা করা হয়েছে। এই মূল্য হ্রাসের কোন প্রভাব অর্থনীতি কিংবা বাজারে পড়বে না। ভোক্তাও এর কোন সুফল পাবে না। এর সুফল পাবে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) ও খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ স্বল্প মূল্যে চাল পাবে। এক কোটি মানুষের কাছে স্বল্প মূল্যে এই চাল পৌঁছে দেয়ার কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এতে কোটি মানুষের কাছে যে চাল পৌঁছবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, প্রতিদিন ডিলারদের যে বরাদ্দ দেয়া হয়, ক্রেতাদের লাইনের মাঝপথেই তা শেষ হয়ে যায়। ফলে ওই ক্রেতাকে আবার পরদিন গিয়ে লাইন ধরতে হয়।
তবে এই উদ্যোগটি চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু চালের বাজারে বড় ক্রেতা হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। দাম না কমলে এদের বাজার থেকেই উচ্চ মূল্যে চাল কিনে খেতে হবে। উচ্চবিত্তদের খুব বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। তারা সরু চালের ভোক্তা এবং মাসে তাদের ২০ কেজির বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজন হয় মাসে ৪০ থেকে ৫০ কেজি। কারণ, তাদের সিংহভাগই তিনবেলা ভাত খায়। মূলত বাজারে তাদেরই চাপ পড়ে। কিন্তু মোটা চালের দামই এখন ৬০ টাকায় উঠে যাওয়ায় এই শ্রেণী খুবই সমস্যায় আছে। তাই বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে চালের দাম কমিয়ে আনা জরুরী হয়ে পড়েছে।
যে পরিমাণ শুল্ক কমানো হয়েছে, তাতে প্রতিকেজি চালে অন্তত ১০ টাকা কমে আসার কথা। এজন্য দেশে যথেষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে চাল আমদানি করা হলে বাজার নিয়ে কেউ কারসাজি করতে পারবে না। এজন্য তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শুল্ক-করে ছাড় দেয়া হলেও দুর্বল তদারকির কারণে অনেকক্ষেত্রে এর লক্ষ্য পূরণ হয় না। মাঝখান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা এর সুফল ভোগ করে। এবার যাতে সেই সুযোগ মধ্যস্বত্বভোগীরা না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।