বঙ্গবীর ওসমানী : বাঙালির অমূল্য সম্পদ

31

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

আজকে এমন একজন মানুষকে নিয়ে লিখছি, যাঁর নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস পুরোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। লেখা শুরুর আগে আমি সাধারণত বেশ কয়দিন প্রচুর পড়াশোনা করি বিষয়টির উপর। এই মানুষটির ব্যাপারে যখন আর্টিকেলের পর আর্টিকেল পড়ছিলাম, দুই-একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলাম, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছিল। ঠিকমতো লিখতে পারবো তো? উনার জীবনটা অনেক মহিমান্বিত। সবকিছু এই অতি ক্ষুদ্র লেখায় তুলে ধরতে পারবো তো?
আমার খুবই ইচ্ছে করছে, নাম বলার শুরুতেই মোঘল সম্রাটদের দরবারে যেমন অনেক স্তুতিবাক্য পাঠ করা হয়, তেমন করে অনেকগুলো স্তুতিবাক্য পাঠ করতে। কিন্তু অহেতুক লেখা দীর্ঘ না করাটাই শ্রেয়। তবে কিছু ব্যাপার প্রথমেই উল্লেখ করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এবং স্বাধীন হওয়ার পর, এমনকি উপমহাদেশ বিভাগের পূর্বেও, রাষ্ট্রের কঠিন দুঃসময়ে আমরা মানুষটিকে পেয়েছি দেশের স্বার্থে নিয়োজিত অবস্থায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বিলিয়ে দিয়েছেন এই প্রিয় দেশটিকে, বিয়েথা করেননি, রয়েছেন চিরকুমার। মানুষটিকে আমরা চিনি এম. এ. জি ওসমানী নামে; জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। মানুষটির জীবনী তাঁর নামের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল। তাই লেখার নামে এটা উল্লেখ করেছি, সকল সাধারণ জ্ঞান বইতে, প্রধান সেনাপতির নাম লিখে দিয়েই শেষ। আর আমরাও মুখস্থ করেই শেষ। কিন্তু নামের পেছনেও যে একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ রয়েছে, যাঁর অবদান আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই মানুষটিকে কখনো খুঁজতে যাই না।
শৈশব : ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি সাধারণ জ্ঞানের বইতে পড়েছি মানুষটির নাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে তাঁর জন্ম। বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান, মা জুবেদা খাতুন। বাবার কর্মস্থল ছিল সুনামগঞ্জ। পৈতৃক নিবাস অবশ্য সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার দয়ামীরে। ওসমানী ছিলেন দয়ামীরের শাহ্ নিজামুদ্দিন ওসমানীর বংশধর। ধারণা করা হয় যে, হজরত শাহজালাল (রহ.) যখন সিলেটে আসেন ১৩০৩ সালে, তখন যে ৩৬০জন আউলিয়া তাঁর সাথে এসেছিলেন, তন্মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাহ্ নিজামুদ্দিন ওসমানী। বালাগঞ্জ থানার নাম বর্তমানে পাল্টে রাখা হয়েছে ওসমানী নগর। সাধারণ একটি পরিবারে অতি সাধারণ হয়েই জন্মেছিলেন ওসমানী, জন্মেই অসাধারণ ছিলেন, তা কিন্তু না। তিনি তাঁর কর্ম দিয়ে নিজেকে বরণীয় করে তুলেছেন, নিজ জীবনকে করে তুলেছেন লাখো মানুষের পাঠযোগ্য। দুই ভাই আর এক বোনের মাঝে ওসমানী ছিলেন সবার ছোট। বাল্যকালে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘আতা’। বর্তমানে তিনি ‘বঙ্গবীর’ নামেই অধিক পরিচিত। পাকিস্তান আর্মিতেও কিন্তু তাঁর একটা পরিচিত নাম ছিল; ‘চধঢ়ধ ঞরমবৎ’।
ওসমানীর পিতা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, পরবর্তীতে আসামের জেলা প্রশাসকও হয়েছিলেন তিনি। আসাম সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়াতে ওসমানীকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আসাম ও সিলেটের নানা স্থানে।
খান বাহাদুর মফিজুর রহমান যখন গৌহাটিতে কর্মরত, ব্রিটিশ-ভারতের তৎকালীন সময়ে আসামের গৌহাটির হোম সেক্রেটারি ছিলেন স্যার চার্লস রোডেন্স। তার সাথে বাঙালীর মানসিক দূরত্ব ছিল বেশ, কেন না বাঙালি ততদিনে বুঝে গিয়েছে, ব্রিটিশরা প্রতিনিয়ত শাসনের নামে শোষণ করে চলেছে তাদের। চার্লস রোডেন্সের সময়েই গৌহাটির সাবডিভিশনাল অফিসার ছিলেন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান। তাদের দুজনের ছেলে-মেয়ের মাঝেই ছিল ঘনিষ্ঠতা। তারা সারাক্ষণই দুরন্তপনায় মেতে থাকতো, অনেক সময় দুপুরের নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে। বাড়ির ছোট ছেলের অনিয়ম নিয়ে ওসমানীর বাবা-মাও তাঁকে তেমন কিছু বলতো না, কারণ ওসমানী ছোটবেলা থেকেই ছিল পড়াশোনায় দুর্দান্ত মনোযোগী। তাঁর বাবা-মা বিশ্বাস করতেন যে, এই ছেলে একদিন বড় কিছু করবে।
শিক্ষাজীবন : ওসমানী তাঁর শিক্ষাজীবনে খুবই মনোযোগী ছিলেন। তার প্রমাণ হলো স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন তিনি। সেই সাথে গৌহাটিতে পেয়েছিলেন সমৃদ্ধ এক শৈশব। ১৯২৩ সালে গৌহাটির কটনস স্কুল অব আসামে শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা।
১৯৩২ সালে তিনি সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। সমগ্র বৃটিশ ভারতে তিনি প্রথম হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রিটোরিয়া পুরস্কার প্রদান করেছিল। এই অ্যাওয়ার্ডটি প্রদান করা হয় সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির জন্য। ১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। স্নাতক শেষ করেই আবেদন করেন সেনাবাহিনীতে যোগাদানের জন্য। ১৯৩৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেন তিনি। ওসমানীর বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট, তাই তিনিও চেয়েছিলেন সেই সময়ের এত সম্মানীত পেশায় পিতার পথেই হাঁটবে পুত্র। কিন্তু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাশ করা ওসমানী সিদ্ধান্ত নিলেন সৈনিকের জীবনকেই বেছে নিবেন তিনি। ধারণা করা হয় যে, সমগ্র জীবনে শুধু মাত্র এই একবারই ওসমানী তাঁর বাবার বিরুদ্ধাচরণ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্য সিলেক্ট হয়েও এই রাজকীয় এক জীবনকে পেছনে ফেলে বেছে নেন একজন সৈনিকের কঠোর জীবন। এই হলেন আমাদের ওসমানী।
ওসমানী যখন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যান, ইন্টারভিউতে একজন বোর্ড মেম্বার প্রশ্ন করেছিল, “আপনি কি মনে করেন, আপনার উচ্চতা একজন সৈনিকের জন্য যথোপযুক্ত?” বলাবাহুল্য যে, ওসমানীর উচ্চতা খানিক কমই ছিল, তিনি এই প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, “যদি হিটলারের মতো মানুষ এই পুরো পৃথিবী নাড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না?” বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্ধারণ কমিটির সকলেই ওসমানীর আচরণে অভিভূত হয়ে যায়, সেই বছরেই জুলাই মাসে সিভিল সার্ভিসের যোগদানের সুযোগ বাদ দিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ওসমানী।
কর্মজীবন : ১৯৩৯ সালে তিনি রয়্যাল আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতীয় মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার হিসেবে। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। তৎকালীন সময়ে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই তিনি এক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়নের কমান্ডর হিসেবে তিনি বার্মা সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনে। এ সময়ে তিনি উন্নীত হন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে। ১৯৪৭ সালকে উপযুক্ত সময় মনে করে বঙ্গবীর ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠায় জেনারেল অকিনলেকের পেছনে নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকেন। সময় বুঝে বারবার অকিনলেকের কাছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রস্তাবণার কথা তোলেন তিনি। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, “যেহেতু দেশ বিভাগ, ডকুমেন্টস ভাগাভাগি, সরকার গঠনসহ যাবতীয় ব্যবস্থা আপনাদের সহযোগিতায় হচ্ছে; সেহেতু অনুগ্রহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যাতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়, তার ব্যবস্থা করে দেবেন।”
জেনারেল অকিনলেক তখন দুটো চিঠি লিখেন। একটি লিখেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নার কাছে, অপরটি পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল গ্রেসির কাছে। চিঠিতে তিনি অনুরোধ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের প্রস্তাবনার কথা। অবশেষে ওসমানী প্রস্তাবনায়, জেনারেল অকিনলেকের অনুরোধে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় পিএনজি গঠন স্থগিত রেখে বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করে। এই ঘটনাটি উল্লেখ করলাম, কারণ ১৯৫১ সালে লে. কর্ণেল ওসমানী উদ্যোগী হয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তিই ছিল ওসমানীর গড়া সেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে পূর্ব বাংলায় এসেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রাম সেনানিবাস। ১৯৫৭ সালে তিনি উন্নীত হন কর্ণেল পদে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সামরিক পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ওসমানী ছিলেন একজন সৎ, আদর্শবান ও নিষ্ঠাবান সৈনিক। বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করেও কর্মে নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সামরিক বাহিনীর সুনাম ও খ্যাতির চেষ্টায় আপ্রাণ পরিশ্রম করতেন তিনি। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। তিনি মাত্র দু’টি ব্যাটালিয়ন থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংখ্যা ছয়টিতে বৃদ্ধি করেন। এতে বাঙ্গালীর সংখ্যা ২ থেকে ১০ এর অধিক করা এবং বাঙ্গালীদের জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যা অনুপাতে কমিশন ও অফিসার পদসহ সর্বস্তরে বাঙ্গালী সিনিয়রদের জন্য পদ সংরক্ষণ করেন।
তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা “চল চল চল” কে পাকিস্তান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসেবে অনুমোদন লাভ করান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরোটাই গড়ে উঠেছিল তাঁরই নিরলস চেষ্টায়। বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আচরণে ও ব্যবহারে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে প্রথমবার অবসর গ্রহণ করার পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মন্ত্রীসহ উচ্চ পদের প্রস্তাব পেয়েও গ্রহণ করেননি তিনি।
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনীতি : সামরিক বাহিনী থেকে ওসমানী অবসর গ্রহণের পর জীবনের এই পর্যায়ের সূচনা ১৯৭০ সালে। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। গড়পরতা মানুষের মতো স্ত্রী সন্তান নিয়ে সৌখিন অবসর জীবন তিনি পাননি। কারণ যুদ্ধ বিগ্রহ আর পেশাগত জীবনে নিজেকে এমনভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিয়ে করার সময় হয়ে ওঠেনি তাঁর। তিনি নিজেও অবশ্য এ ব্যাপারে আফসোস করেননি। তিনি ভাবতেন, একজন সৈনিককে সৌখিন জীবন মানায় না। রাজনীতিতে নেমেই পেলেন ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী ১৯৭০ এর নির্বাচন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের চারটি থানা নিয়ে গঠিত উভয় পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ নির্বাচনী এলাকা থেকে জয় লাভ করে তিনি জাতীয় সংসদে আসন লাভ করেন।
যুদ্ধকালীন পর্যায় : জেনারেল ওসমানীর বিখ্যাত গোঁফ, যার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকার থেকে মাসিক ভাতা পেতেন।
২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাতেই ছিলেন ওসমানী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বছর চারেক আগে অবসর নেয়া ওসমানীর সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে পারিস্তান সরকার অবগত ছিল। তাই ঐ রাতেই ওসমানীকে হত্যার চেষ্টায় হন্যে হয়ে খোঁজে পাকবাহিনীর এক কমান্ডো। কিন্তু একেবারেই ভাগ্যগুণে অনেকটা অলৌকিকভাবে প্রাণ বেঁচে যায় ওসমানীর। এত পরিচিত চেহারা নিয়ে তিনি নিরাপদে পালিয়ে ছিলেন, সেটাও আমাদের আশ্চর্য করে। পরবর্তীতে মনজুর আহমদ নামক এক ব্যক্তির সাক্ষাতকারে এই ব্যাপারে তিনিই খোলাসা করেন, বলেন যে, হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিখ্যাত গোঁফ জোড়াটি কামিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকা থেকে তিনি পালিয়েছিলেন ২৯শে মার্চ। এর আগের চারদিন ঢাকার ইস্কাটনের একটি ফাঁকা বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। খানসেনারা তাঁকে খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজছিল। তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে চালিয়েছিল হামলা। প্রতিটি ফাঁকা ঘরেই মেশিনগান চালিয়েছে। নিউ ইস্কাটনের বেশ কয়েকটি বাড়িতেও তারা হামলা চালিয়েছিল, কিন্তু ওসমানী যে বাড়িতে ছিলেন, সেটায় হানা দেয়নি। এ ব্যাপারে ওসমানী উল্লেখ করেন, “পরম করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহ ছিল তাঁর ওপর। তা না হলে এমনভাবে কজন রক্ষা পায়!” ২৯ মার্চ, নদীপথে পালিয়ে গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেন তিনি। শুরু হয় ওসমানীর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পাক-ভারত যুদ্ধের পর এবার শুরু হয় নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ; যা ছিল স্বজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। নিজের সবটুকুই বিলিয়ে দেন তিনি এই যুদ্ধে।
৯ই এপ্রিল, ১৯৭১; ওসমানী সিলেটে যান মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানতে। সেখানে তিনি এম. আজিজুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এম. আজিজুর রহমান, তিনি ওসমানীর সাথে কাজ করার সময়ের কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন। তারই বিবৃতিটি সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে উল্লেখ করা হলো।
“একটা ব্যাপার আমাকে সবসময়ই পীড়া দিয়ে এসেছে যে, বঙ্গবীর জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর ব্যাপারে মানুষ খুবই কম বিবৃতি প্রদান করেছে। এমনকি তারাও তাঁকে স্মরণ করেনি যারা স্বাধীন বাংলায় জেনারেল ওসমানীর কঠোর পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে। জেনারেল ওসমানী; তাঁর নামটাই শত্রুবাহিনী সহ সকল বাঙালি অফিসারকেও শঙ্কিত করে তুলতো, এমন কোনো ঘটনাস্থল ছিল না কিংবা এমন কেউ ছিল না যার সমূহ বিপদ ছিল আর ওসমানী সেখানে হাজির হননি। কিন্তু বর্তমানে তাঁর নামে শ্রদ্ধায় মানুষ মাথা নোয়াচ্ছে, এমনটা দেখাই যায় না। একজন সফল নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তাঁর মাঝে সবই ছিল।
মাস্টার্স সমাপ্তির আগেই তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্য একজন ক্যাডার মনোনীত হন। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে। জেনারেল ওসমানীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল। আমি আমার দলকে নিয়ে সুরমা নদীর তীরে কীন ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান করছিলাম। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে চলছিলো ভারী গোলাবর্ষণ। সেই সাথে আকাশপথেও পাক বিমানবাহিনী গোলাবর্ষণ চালায়। সুরমা নদীতে সেদিন শুধু মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছিল। তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল ফ্রন্ট লাইনে সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। সেটা করারই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পথিমধ্যে শত্রুদের গুলিতে আমার জীপ অচল হয়ে পড়লে জল্লারপাড় মসজিদের কাছাকাছি আমি লাফ দিয়ে পড়ি। এক অর্ধনির্মিত দালানের ছাদে গিয়ে উঠি। ছাদ থেকে বেশ ভালোমতোই আমি দেখতে পাই চারপাশের অবস্থা। হঠাৎ এক দৃঢ় কণ্ঠ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে যে, ওহে যুবক, কী চলছে এখানে? তখনও আমি জানিনা যে, তিনিই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী (যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হন), আগে কখনো দেখা হয়নি তাঁর সাথে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি কখনো, ওরকম ছোট দৈহিক গঠনের একজন আগন্তুক, যার পরিচয়, তিনি এই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, তাঁর অত সাহস আর কৌতূহল যে, যুদ্ধের খোলা ময়দানে এভাবে একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে অনেক লম্বা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে আমার কাছে আসার জন্য। তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা শুনে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নেন আর খুব দক্ষতার সাথেই পুরো পরিস্থিতি নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
ওসমানী সাহেবের সাথে পরবর্তীতে আমার দেখা হয় ভারতীয় বর্ডারে অবস্থিত খোয়াই হাসপাতালে। আমি তখন শেরপুরের যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওসমানী ফ্রন্ট লাইনে আমার খবর শুনে তৎক্ষণাৎ সেখানে আসেন। আমার অবস্থা আর চিকিৎসা (অসমাপ্ত)