জগন্নাথপুরে বন্যায় এবার হাওরে পলিমাটি, কৃষকদের জন্য অভিশাপ ও আশির্বাদ

5
জগন্নাথপুরে পলি মাটিতে ভরাট হওয়া জমি রোপণ ও দূর থেকে পানি এনে হালচাষ।

মো. শাহজাহান মিয়া জগন্নাথপুর থেকে :
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ভয়াবহ বন্যার পানিতে আসা পলিমাটিতে এবার হাওরের জমি ভরাট হয়ে গেছে। এতে বদলে গেছে ভূ-প্রকৃতির চিত্র। পলিমাটিতে সমানে জমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় জমির পুরনো সীমানা বাঁধ (আইল) খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে জমি চেনা নিয়ে নতুন সমস্যায় পড়েছেন জমির মালিক ও কৃষকরা। এছাড়া রোপা আমন আবাদ নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে অনেক সমস্যা ও সম্ভাবনা। পলিমাটিতে জমির সাথে জমির পাশে থাকা ছোট ছোট খাল-বিল ও নালা ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে ভরাট হয়ে যাওয়া জমির আশপাশে এবার পানি না থাকায় জমি আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এর মধ্যে অনেকে শুধু পানি সংকট আতঙ্কে আগাম ধান রোপন করেছেন। দেশের বিভিন্ন উঁচু স্থানের বীজতলা থেকে চড়াদামে চারা কিনে জমি রোপন করেন। কেউবা আবার স্থানীয় ভাবে উঁচুস্থানের বীজতলায় চারা বপন করেন। অনেকে অন্য বছরের মতো সময়মতো বীজ বপন করে জমি আবাদ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। পলিমাটি ভর্তি জমি শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। এসব জমিতে হালচাষ করতে গিয়ে পড়েছেন পানি সংকটে। তাই জমি আবাদের স্বার্থে অদূরে থাকা নদী থেকে পানির মেশিনে দীর্ঘ পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতেও দেখা দিয়েছে বিপত্তি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির হাল খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যাদের নিজের ট্রাক্টর রয়েছে, তারা রয়েছেন সুবিধায়। আর যাদের নিজের ট্রাক্টর নেই, তারাই বেশি সমস্যায় পড়েছেন। অন্য বছর প্রতি কেদার জমি ৫শ থেকে ৬শ টাকায় হাল দেয়া গেলেও এবার ১২শ থেকে ১৫শ টাকা হয়ে গেছে। তাও সময় মতো হাল দেয়া যাচ্ছে না। ট্রাক্টরের মালিক অনেকের জমি আবাদ করতে গিয়ে সবাইকে সময় মতো হাল দিতে পারছেন না। তবে এবার এতোসব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও জমি আবাদে অন্য বছরের তুলনায় বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা।
২৭ আগষ্ট শনিবার উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের খাশিলা গ্রামের বাদে খাশিলা হাওরে সরেজমিনে দেখা যায়, হাওরের অধিকাংশ জমি পলিমাটিতে এলোমেলো ভাবে ভরাট হয়ে গেছে। পলিমাটিতে জমির সাথে ছোট ছোট খাল-বিল ও নালা ভরাট হওয়ায় অনেক দুরে থাকা নদী থেকে মেশিন দিয়ে পানি সংগ্রহ করে জমি আবাদ করছেন কৃষকরা। এ সময় কৃষকরা জানান, এবার বন্যার পানির সাথে পলিমাটি এসে দেড় থেকে দুই ফুট পরিমাণে জমি ভরাট করে দিয়েছে। এতে বদলে গেছে হাওরের চিত্র। আশপাশে পানি না থাকায় দুর থেকে পানি এনে জমি আবাদ করতে হচ্ছে। এতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের জন্য জমি করা এবার অভিশাপ হলেও আবাদ করছি। আবাদ না করলে জমি পতিত হয়ে যাবে। এ সময় কৃষক এনামুল হক জানান, পানি সংকটের ভয়ে আমার সাড়ে ৩ কেদার জমি আগেই রোপন করেছি। কৃষক ও জমির মালিক শিপন তালুকদার জানান, আমার বেশ কিছু জমি বর্গাচাষীদের দিয়েছিলাম। তবে একে তো জমি ভরাট হয়ে গেছে, তার উপর ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা জমি করতে পারবে না মর্মে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই পানি সংকটে জমি আবাদ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে-এবার মইয়ার হাওরে আমন আবাদ হচ্ছে। এক সময় উপজেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম মইয়ার হাওরে বোরো আবাদ হতো। কালের পরিক্রমায় ক্রমান্বয়ে এলোমেলো পলিমাটিতে হাওরের অধিকাংশ ভরাট হওয়ায় দীর্ঘ অনেক বছর যাবত এ হাওরে আংশিক বোরো আবাদ হলেও পুরো হাওর পতিত থাকে। এবার আরো বেশি পলিমাটিতে ভরাট হওয়ায় আমন আবাদ হচ্ছে। এক সময়ের বোরো জমি এখন আমন হয়ে গেছে। তাই এবার অনেক বছর পর মইয়ার হাওরের বালুচরে আমন আবাদের হিড়িক পড়েছে। কৃষকরা মনের আনন্দে রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক আমন আবাদ করছেন। তাই এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে পলিমাটিতে হাওর ভরাট হওয়া আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এভাবেই উপজেলার বিভিন্ন হাওর ও বাড়ির আঙ্গিনায় এবার কমবেশি পলিমাটি ভরাট হয়েছে। যা বদলে দিয়েছে ভূ-প্রকৃতির চিত্র। কৃষিতে দেখা দিয়েছে নতুন নতুন সমস্যা ও সম্ভাবনা। এখন থেকে কৃষকদের বদলে যাওয়া চিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে জমি আবাদ করতে হবে। হাওরে জমি আবাদকালে কৃষকরা এভাবেই তাদের দুঃখ, কষ্ট ও সম্ভাবনার কথা জানান।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান মজুমদার জানান, এবার জগন্নাথপুর উপজেলায় ৯ হাজার ৪৬৫ হেক্টর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমি রোপন হয়ে গেছে। চলতি সপ্তাহে বৃষ্টিপাত ভালো হওয়ায় কৃষকরা রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক জমি আবাদ করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এবারের বন্যার সাথে আসা পলিমাটিতে বিভিন্ন হাওরের কিছু জমি ভরাট হয়েছে। এতে কৃষকদের কিছু সমস্যা হলেও অনেক জমিতে নতুন করে বুনা আমন আবাদ হচ্ছে। প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে এবার আমনের বাম্পার ফলন হবে।