ভাষাতত্ত্বের বিবর্তন

371

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষাতত্ত্ববিদগণ ঐতিহাসিতাকেই তাঁদের তত্ত্বগত ধারণার মূল আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছিলেন, বিংশ শতাব্দীতে ভাষাতাত্ত্বিকদের ধ্যান- ধারণা হলো ভাষাব্যবস্থার সংগঠন অনুসন্ধান। পুরাতন বৈয়াকরণেরা প্রায় সর্বদাই মনস্তত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, প্রাণীতত্ত্ব, সামাজবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হতেন। বিশ শতকের সাংগঠনিক ভাষাতাত্ত্বিকেরা এ ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনায়ন করেন। এ সময়ে ভাষাতত্ত্ব গবেষণা পদ্ধতিতে কেবল অন্য শাস্ত্রের সমকক্ষ হয়ে উঠলোনা, বরং ভাষাতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা বিভিন্ন শাস্ত্রে ব্যবহৃত হতে লাগলো। পূর্বতন ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক এবং সমকালীন ব্যাকরণ এমনভাবে সম্পৃক্ত ছিলো যে একটি ভাষার বর্তমান রূপ ঐ ভাষার পূর্বতন পরিবর্তনের আলোকেই কেবল মাত্র বিচার করা যেত। সাংগঠনিক ব্যাকরণে ভাষার কালানুক্রমিক ও বর্তমান রূপের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা হলো, ভাষার কালনুক্রমিক ও বর্তমান রূপের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা হলো, ভাষার বর্তমান রূপের বিন্যাসরীতি সাংগঠনিক রীতিতে নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিবর্তনের ওপর আলোক নিক্ষেপ করা হতো; সাংগঠনিক রীতিতে একটি ভাষার ইতিহাস ভাষার বিবর্তনকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে রচিত হয়, তার একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নয়। কি কারণে একটি ভাষাতাত্ত্বিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে অন্য একটি ব্যবস্থার আগমন ঘটে ভাষার বিবর্তন আলোচনায় সাংগঠনিক রীতিতে সেইটেই মুখ্য বিবেচ্য। ভাষার সংগঠন বিশ্লেষণ থেকে কেবলমাত্র ভাষাব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বতন ধারণার পরিবর্তন ঘটেনি, সঙ্গে সঙ্গে ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা উপভাষা সম্পর্কে ধারণারও রূপান্তর ঘটেছে। ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস বা ক্রমবিবর্তন এবং সংগঠনের মাধ্যমে একটি তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিভিন্ন ‘স্ট্যান্ডর্ড’ বা ‘শিষ্ট’ আধুনিক কথ্য ভাষা বিশেষ সামাজিক বা ঐতিহাসিক কারণ কোনো না কোনো উপভাষা থেকেই উদ্ভুত এবং আঞ্চলিক ভাষা শিষ্ট বা সাধু ভাষার বিকৃত রূপ নয়। ফলে উপভাষাতত্ত্ব বা ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোলশাস্ত্র একটি ভাষার উপ বা আঞ্চলিক রূপ বৈচিত্র্য সম্পর্কে উপাদান ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। উপভাষা গবেষণার ফলে ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে অধিকতর নির্ভরযোগ্য ধারণা লাভ করা গেছে। বোঝা গেছে যে স্ট্যান্ডার্ড ভাষাও একটি সামজিক উপভাষা।
উপভাষাতত্ত্বে অগ্রণী জার্মান ও ফরাসি পণ্ডিতেরা, পরবর্তী কালে ইতালিয়ান ভাষাতত্ত্ববিদারাও আঞ্চলিক ভাষাতত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রথম বিখ্যাত উপভাষা মানচিত্র ‘¯প্রাখআতলাস্ দ্য দুসেন রাইখস’ (১৮৭৬) জার্মান ভাষাবিদ জর্জ ওয়েংকার প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর উপভাষা প্রশ্নমালার উত্তর ভাষাতত্ত্বে প্রশিক্ষণহীন পল্লী স্কুল-শিক্ষকদের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়েছিলো বলে খুব নির্ভরযোগ্য হয়নি। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোলশাস্ত্রের উদগাতা প্রখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত জুল গিলিয়েগাঁর (১৮৫৪-১৯২৬) ভাষাতাত্ত্বিক ব্যুপত্তি ঊনিশ শতকের সত্তর ও আশি দশকের ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক গ্যাস্টন গ্যারী, ডার্মেস্টের, লই হ্যাভেত ও পল মেইয়ের প্রভাবে গঠিত হয়েছিলো। গিলিয়েগঁ ফরাসি উপভাষা জরিপে দুই হাজার প্রশ্নসম্বলিত একটি প্রশ্নমালা ব্যবহার করেন, এবং তাঁর উত্তর সংগ্রহেই এডমন্ট নামে একজন দক্ষ কর্মীকে নিযুক্ত করেন। তিনি ফরাসি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে ওই প্রশ্লমালায় উত্থাপিত বিষয়গুলো সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করেন স্বাভাবিকভাবেই ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক মানচিত্র জার্মান উপভাষা মানচিত্রের চেয়ে অধিকতর নির্ভযোগ্য হয়েছিলো। ফরাসি মানচিত্র আত্লাস্ লিঙ্গুইস্তিক দ্য ফ্রাসেঁ’ ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে সংগৃহীত উপাদান ও তথ্যের ভিত্তিতে ১৯০১-১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত। ফরাসি উপভাষা জরিপের সমসাময়িক কালে স্যার জর্জ স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন ভারতীয় উপমহাদেশের উপভাষা জরিপ করেন; তিনি জার্মানির জর্জ ওয়েংকারের মতো উপভাষার উপাদান সংগ্রহে বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল শিক্ষকদের সহায়তা গ্রহণ করেন। তিনি প্রচলিত প্রকটি গল্পের সাধুভাষা রূপ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন এবং শিক্ষকেরা স্বস্ব অঞ্চলের ভাষার রূপান্তরিত করে গল্পটি লিখে পাঠান। এভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা ও উপভাষার নমুনা সংগ্রহ করে গ্রেয়ার্সন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কয়েক খণ্ডে ‘লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ প্রকাশ করেন। ইতালির ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোল ‘¯প্রাখ-উন্ড সাখাতলাস ইতালিয়েন উন্ড সুদসউইজ’ (১৯২৮) প্রণয়ন করেন কে জেবার্গ এবং জে জুড। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোল শাস্ত্রের অবদান প্রধানত শব্দের বিশ্লেষণে প্রতিভাত হয়েছিলো, মুখের ভাষার প্রচলিত শব্দের পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে উপভাষাতাত্ত্বিকেরা শব্দার্থ, বিকিরণ এবং বাক্য তাদের ভূমিকার কথা মনে রেখে শব্দের ইতিহাস পুনর্গঠন করতে চেয়েছেন। ভৌগলিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের সহায়তায় শব্দের ইতিহাস ব্যাখ্যার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিলো। শব্দের ইতিহাস নির্ণয়ে জাতীয় মনস্তত্ত্ব এবং প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণাদি সতর্কভাবে পরীক্ষা করা হতো। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোলবিদেরা একটি ভাষা উদ্ভব ও বিকাশে যেসব উপাদানের সংস্পর্শে আসে উপভাষা বিশ্লেষণে সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন বিশ্বাস করতেন। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোলের তত্ত্বগত ধারণা ছিলো নিম্নরূপ : একটি ভাষার উপভাষাগত পার্থক্য মূলত শব্দ ও ধ্বনি সংগঠনে পাওয়া যায়, তুলনামূলকভাবে পার্থক্য রূপ এবং বাক-পর্যায়ে কম। সমাজিক এবং ঐতিহাসিক কারণসমূহ ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপভাষার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কারণ বিভিন্ন সামন্ত প্রভুর অধীন বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠে; তুলনামূলকভাবে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শাসনে বিভিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা কমে আসে এবং উপভাষার সংখ্যা হ্রাস পায়। ভৌগোলিক অবস্থা ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; যেমন-সমতল ভূমির তুলনায় পার্বত্যভূমির ভাষাতাত্ত্বিক ‘প্রান্তিক’ অঞ্চলে, সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে একটি ভাষাতাত্ত্বিক উদ্ভব বা আগম সহজেই সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু একটি পার্বত্য অঞ্চলের ভাষা ভৌগোলিক কারণে সমতল ভূমিতে পরিবব্যাপ্ত মূল ভাষার বিকাশ ও বিবর্তন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। উপভাষা বিলোপ বা অবক্ষয়ের গতি সাম্প্রতিক কালে দ্রুততর হয়েছে,কারণ গ্রামের মানুষ শহরের সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণের চেষ্টা করছে।
ফরাসি উপভাষাবিদ গিলিয়েগ’ শব্দভাণ্ডারে উদ্ভব বা আগমের দুটি কারণ নির্দেশ করেছেন, একই ধ্বনি বিশিষ্ট ভিন্নার্থক শব্দের সংঘত এবং শব্দ সংগঠনের অনুপযোগিতা। একই ধ্বনি বিশিষ্ট শব্দের ভিন্ন পরিবেশের জন্য নির্দিষ্ট ভিন্ন অর্থ যখন একই পরিবেশে ব্যবহৃত হতে থাকে, তখন নির্দিষ্ট তাৎপর্য ব্যাহত হয়, ফলে একটি নতুন শব্দ ওই দুটি ভিন্ন অর্থের একটিকে গ্রহণ করে এবং একই ধ্বনিবিশিষ্ট ভিন্নার্থক পরিবেশের অবসান ঘটে। যেমন, ফরাসি গাসকন উপভাষার ‘গাত’ শব্দটির দুটি অর্থ ছিলো: ‘বিড়াল’ ও ‘মোরগ’;-অনেক বাক্যে এটা বোঝা যাচ্ছিলো না যে কথক কি বলছেন, কুকুরটা বেড়াল ধরেছে না মোরগ? ফলে ‘গাত’ শব্দটি কেবল বেড়াল অর্থেই ব্যবহৃত হতে থাকে। শব্দের ধ্বনিসংগঠন সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়, একটি শব্দ হয়তো আদিতে ব্যবহার উপযোগী ছিলো, ক্রমশ হয়তো শব্দটি হ্রস্ব বা দীর্ঘ হয়ে পড়ে অথবা হয়তো এমন কোনো ধ্বনি-উপাদান তাতে সংযোজিত হয় যে তার দ্বারা ভিন্ন অনুষঙ্গ সৃষ্টি হয়, ফলে একটি নতুন উপযোগী শব্দের উদ্ভব স্বভাবতই আশা করা যায়। এভাবে সমধ্বনিবিশিষ্ট ভিন্নার্থক শব্দ ও অনুপযোগী সংগঠনের কারণে নতুন শব্দের সৃষ্টি হতে পারে। সাংগঠনিক পদ্ধতিতে অধিকতর সংখ্যায় উপভাষার বর্ণনামূলক বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে; উপভাষা বৈশিষ্ট্য কেবল তথ্য হিসেবে উপস্থাপিত না হয়ে যে নিয়মে বিশেষ বিশেষ নির্দিষ্ট পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে, তার ওপর আলোক নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন উপভাষার সমান্তরাল ব্যবস্থাসমূহের তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন উপভাষার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের স্ফুটনে ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্বের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সাংগঠনিক বিশ্লেষণের ফলে উপভাষাতত্ত্বে বহু নতুন ধারণা সংযোজিত হয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিক ভূগোল শাস্ত্রে সম্পর্কিত ভাষাগুলো সম্পর্কেও অনুসন্ধান চলছে; যেমন একটি দ্বিভাষী সম্প্রদায়ে ভাষা-ব্যবস্থার অবস্থা পর্যবেক্ষণ, যেখানে সহ-অবস্থানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা সংগঠন পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছে সেখানে পারস্পরিক প্রভাব পর্যালোচনার মাধ্যমে ব্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে আসা গেছে। যোগাযোগ প্রক্রিয়া পর্যালোচনায় মনস্তাত্ত্বিকেরা ভাষাতত্ত্ববিদের মতোই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং ফলপ্রসূ গবেষণা চলছে । মার্কিন উপভাষাবিদ হ্যানস কুরাথ, র‌্যাভেন ম্যাকডেভিড, উইলিয়ম লেবভ প্রমুখ ভাষার বৈচিত্র অবলোকনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন এবং ‘সামাজিক ভাষাতত্ত্বে’র প্রবক্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁরা ভাষার ভৌগলিক বা আঞ্চলিক বৈষম্য অপেক্ষা সামাজিক বৈচিত্র্য অবলোকনে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পোলিশ ভাষাতত্ত্ববিদ ডব্লিউ ডারাসজেউইস্কি তাঁর ‘কোয়ানটিটেটিভ আইসোগ্লস’ বা ‘সমশব্দরেখাগুচ্ছের’ পরিমাণগত হিসাবের মাধ্যমে একই ভাষাসম্প্রাদায়ের মধ্যে ভষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পৌনপুনিকতার বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে সমর্থ হয়েছেন।
১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘ফোনেটিক্স’ বা ধ্বনিবিজ্ঞানেরও বিকাশ ঘটে, বিভিন্ন ভাষার ধ্বনির উচ্চারণ স্থান ও রীতি অনুযায়ী ধ্বনির উৎপাদন ও শ্রুতি বিচারের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক্স অ্যাসেশিয়েশন’ ভাষাতত্ত্ববিদ অটো জেফারশনের পরামর্শ অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন, যা বিভিন্ন ভাষার বিবিধ ধ্বনিসমূহের প্রতীক রূপে ব্যবহার করা যায়। এই বর্ণমালা স্থির হয়েছিলো বিশিষ্ট ধ্বনিবিজ্ঞানী হেনরি সুইটের ‘ব্রড’ বা ‘ব্যাপ্ত’ এবং ‘ন্যারো’ বা ‘সূক্ষ্ম’ রোমান বর্ণমালা ভিত্তি করে। আন্তর্জাীতক ধ্বনিলিপিতে প্রথম স্বরধ্বনির জন্যে ছাব্বিশটি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির জন্য বায়ান্নটি প্রতীকের ব্যবস্থা ছিলো, পরবর্তীকালে নবনব ভাষার নতুন নতুন ধ্বনির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের ভিশেষত আমেরিকায় আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপির পরিবর্তন ও সম্প্রসারণ ঘটে। ফরাসি দেশে ‘সাইকোফিজিয় লজিকেল’ বা ‘মনদৈহিক’ ‘সাইকোলজিকেল’ বা ‘মনস্তাত্ত্বিক’ ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। মনস্তাত্ত্বিক-দৈহিক বিশ্লেষণের সাহায্যে ভাষার ধ্বনি প্রক্রিয়া বা সাদৃশ্য -বৈশাদৃশ্যের ক্ষেত্রে যে সব মানসিক ও দৈহিক কারণ কার্যকর, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে শিশুর ভাষা অধিকতর মনযোগ পেয়ে থাকে। ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জে. ডেনড্রিজ এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন যে কোনো কথাই কেবল একটি সরল বিবৃতি নয়, বরং একটি বিশেষ আবেগের প্রকাশ, এ কারণেই কোনো ব্যক্তি একটি তথ্য ঠিক একভাবে দু’বার প্রকাশ করতে পারেনা। ভাষার সামাজিক বিশ্লেষণ বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক ও সামাজিক উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সমাজতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্বের একজন প্রবক্তা এনটয়েন মেইয়ে (১৮৬৬-১৯৩৬); তাঁর দৃষ্টিতে ভাষা একটি সহজসরল বস্তু নয়, ভাষা বিভিন্ন রীতির সংমিশ্রণ যা বিশষ সামাজিক পটভূমিকা বা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে রূপ গ্রহণ করে থাকে। ভাষার গঠনরীতি কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক মান বা বিশেষ সমাজিক পরিবেশ দ্বারাই নয়, বরং মানুষের অর্থনৈতিক ও কারিগরি কর্মকাণ্ড দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত। তাঁর মতে শব্দার্থের পরিবর্তনে ‘সমাজিক কৃতঋণে’র ভূমিকা সবচেয়ে বেশি; একটি শব্দ একই সামাজের এক শ্রেণী থেকে আর এক শ্রেণীতে নতুন তাৎপর্য লাভ করে, একটি সাধারণ শব্দ শ্রেণীভেদে বিশেষ শব্দে বা বিশেষ শব্দ সাধারণ শব্দে পরিণত হয়। শব্দার্থের পরিবর্তন সাধারণীকরণ এবং বিশেষীকরণ এই দুই প্রক্রিয়া থেকে শুরু হয় বলে তিনি মনে করেন। স্টাইলিস্টিক’ বা রীতিবাদী গবেষণাও বিবিধ বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত; ধ্রুপদী রীতিবাদীরা ব্যক্তি কোন ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে তার চরিত্র মেজাজ, ক্ষমতা ও জীবন সম্পর্কে ধারণার প্রকাশ করে থাকে সে বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। একটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির রূপ কোনো কোনো ভাষাতাত্ত্বিক রূপের মধ্যে প্রতিফলিত সে বিষয়ে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করলে রীতিবাদ সামজিকও হতে পারে। বস্তুত ফরাসি সামাজিক ভাষাতত্ত্ববিদেরা মূলত রীতিবাদী ছিলেন; ফরাসি রীতিবাদীরা যেলির প্রভাবে তাঁদের ধারণাকে ব্যাপক ও সম্প্রসারিত করেছিলেন। প্রখ্যাত সুইস পণ্ডিত দ্য সোসীয় ব্যক্তি বিশেষের ভাষাতাত্ত্বিক ‘সৃষ্টিশীলতা’[পারোল] এবং সামাজিক গোষ্ঠীর ‘ভাষাসম্পদ’ [ল্যাঙ্গুয়ে]-এর মধ্যে যে পার্থক্য নির্দেশ করেছিলেন, তার সঙ্গে তৃতীয় ধারণার সংযোজন হয়েছিলো ‘ভাষা’ [ল্যাঙ্গুয়েজ]। ভাষার সামগ্রিকতায় ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় উভয়ের ভাষাই অন্তর্ভক্ত, ব্যক্তিরীতি ‘পারোল’ ব্যক্তির ভাষাজ্ঞানের সঙ্গ, গোষ্ঠীরীতি ভাষার সামাজিক অনুষঙ্গের সাথে সম্পর্কিত। সাধারণ রীতিবাদীরা মানব চেতনার মৌলিক স্পৃহাগুলো কিভাবে ভাষাতাত্ত্বিক রূপ পরিগ্রহ করে, তা অনুধাবনে সচেষ্ট ছিলেন। ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিকেরা ‘স্টাইল’ বা ‘রীতি’ র নিরীক্ষায় ভাষার চিরাচরিত ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ পরীক্ষার রীতি অবলম্বন করেন। এইসব ব্যতিক্রমের কারণ প্রধানত মনস্তত্ত্বেই নিহিত বলে মনে করা হয়েছে; সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে অধিকতর সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ চলছে। বার্গস এবং বেনেদেত্তো ক্রোচের দার্শনিক ভাবধারা ভাষার গঠনে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিমানসের প্রভাবের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে আর দার্শনিক হুগো শুখার্টস-এর মতে ভাষা র্বক্তির সূষ্টি যা অনুকরণের মাধ্যমে গোষ্ঠী আত্নস্থ করে। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভাষার সৃষ্টিতে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বই হচ্ছে চূড়ান্ত; তবে যে পরিবেশ তার ব্যক্তিত্বকে গঠন করেছে সেইসব প্রেক্ষাপট দ্বারা ব্যক্তিমানস নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ভাষা যেহেতু মূলত ব্যক্তির বিশেষ মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ সে কারণে ভাষাকে রীতিবাচক বস্তু মনে করা উচিত। ঐসব দার্শনিক ভাবধারার প্রভাবে ভাষার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয় এবং জার্মানিতে ‘নন্দনতাত্ত্বিক ভাববাদী’ ভোসলার গোষ্ঠীর এবং ইতালিতে ‘নবভাষাতাত্ত্বিক’ গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। কার্ল ভোসলার (১৮৭২-১৯৪৭) ক্রোচে এবং হামবোলটের ভাবধারার প্রভাবে ভাষা সম্পর্কে যে ধারণার প্রচার করেন তা হলো: জীবনের বিভিন্ন বস্তুগত রূপের কোনো নিজস্ব তাৎপর্য নেই, তাদের প্রকৃত তাৎপর্য ধারণার মধ্যেই নিহিত। যা কিছু সৃষ্টি করা হয়, তার মধ্যে কেবল সেগুলোরই অনুসন্ধান করা উচিত যার মধ্যে তার স্রষ্টার তাৎপর্য, স্রষ্টার আত্নিক অনুভুমি এবং স্রষ্টার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেক সৃষ্টি একটি ব্যক্তিত্বর অভিব্যক্তি মাত্র। ভাষা হচ্ছে চেতনার বাহন, যার সাহায্যে মানুষ তার ব্যক্তি ধারণা ও অনুভূতির প্রকাশ করে থাকে, কাজেই ভাষা অনুসন্ধানকারীর একমাত্র কর্তব্য হলো রীতির অনুসন্ধান। একটি ভাব ও তার স্রষ্টা মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে রূপায়িত করে ভাষা। মানুষ তার ভাষা সম্পর্কে সজাগ, কি বলবে এবং কিভাবে বলবে তা সে স্থির করে এবং তা নিয়ন্ত্রিত হয় বক্তার বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক গঠন দ্বারা। মানুষ বিশেষ মনন্তাত্ত্বিক জগতের ধারক এবং ভাষা তার প্রকাশক; কাজেই মনস্তত্ত্ব এবং ভাষার মধ্যে একটা কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে। একজন মানুষের ভাষার মধ্যে সে মানুষটির সারাংশ পাওয়া যায় যে সারাংশ হলো একটি নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শের আকাঙ্খা। স্টাইল বা রীতি বস্তুতপক্ষে একটি মানুষের নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শের ব্যক্তিগত বহিঃপ্রকাশ বা সর্বাধিক স্পষ্ট আত্মপ্রকাশ। মানুষ তার কথার মধ্য দিয়েই নিজেকে আংশিকভাবে প্রকাশ করে এবং মানুষ প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নতুন আবেগময় পরিবেশে প্রত্যক্ষ করে। কাজেই একবার যা বলা হয় তার আর পুনরুক্তি সম্ববপর নয়, পুনরুত্তিতে যে অর্থের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় তা আগের কাছাকাছি যেতে পারে কিন্তু যথার্থ আগেরটি আর হয় না। (অসমাপ্ত)