বিশ^বাজারে কমছে ভোজ্য তেলের দাম আর আমাদের বাড়ানোর প্রস্তাব !

57

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে। প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৯০০ থেকে ১১০০ ডলারে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে আবারও সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ভোজ্যতেল আমদানিকারক মিল মালিক সমিতি। সম্প্রতি ডলারের মূল্য বৃদ্ধিকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, কিছু দিন আগে মূল্য সমন্বয় করে কিছুটা কমানো হলেও বাজারে সেই দামে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন কৌশলে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। বিশ্ববাজারেও তেলের দাম কমার পথে, সেখানে আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অপ্রত্যাশিত।
অবশ্য ভোজ্যতেলে দাম বাড়ানোর বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। তবে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর সয়াবিনের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।
জানা গেছে, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম যখন বাড়তি ছিল, তখন আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা দেশের বাজারে তেল আনলে দাম কমার কথা। লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষ কম দামে সয়াবিন তেল কেনার সুযোগ পাবেন। কিন্তু দেখা গেছে, প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা এর কোনও সুফলই পাচ্ছেন না।
দাম কমানোর সময়ে ব্যবসায়ীদের কণ্ঠেও ছিল উল্টো সুর। তারা যুক্তি হিসেবে বলেছেন, ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চ মূল্যসহ বিভিন্ন কারণে ভোজ্যতেলের দাম কোনোভাবেই আগের অবস্থায় নেওয়া যাবে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। মিল মালিকদের দেওয়া প্রস্তাবে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা, এক লিটারের বোতল ২০৫ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৬০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। গত ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) চিঠি দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মিল মালিকরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ার কারণে সয়াবিন তেল আমদানির ব্যয় বেড়ে গেছে। এ কারণে সয়াবিনের দাম নতুন করে সমন্বয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমদানিতে আমাদের খরচ বেড়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে, এসব বিবেচনা করে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাম সমন্বয় করার জন্য সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ দাম সমন্বয় না করলে তারা লোকসানের কবলে পড়বেন বলেও জানান বিশ্বজিৎ সাহা।
তবে ট্যারিফ কমিশন এই মুহূর্তে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মিল মালিকরা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা চূড়ান্ত করা হয়নি, বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জুলাই ট্যারিফ কমিশনের মধ্যস্থতায় সয়াবিন তেলের দাম কমানোর ঘোষণা আসে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এক লিটারের বোতল ২০৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮৫ টাকা, আর ৫ লিটারের বোতলের দাম হওয়ার কথা ছিল ৯১০ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৬৬ টাকা, আর পাম অয়েল বিক্রি করার কথা সর্বোচ্চ ১৫২ টাকা।
তবে তাতে কোনও কাজ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাজারে তেলের দাম কমেনি। ‘আগের দরে কেনা মাল’ অজুহাতেই বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। নতুন করে কমানো ১৮৫ টাকা লিটারের লেবেল লাগানো বোতলজাত সয়াবিন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোক্তারা মনে করছেন, নতুন দরের তেল বাজারে না পাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। তাদের সঙ্গে মিলাররাও কারসাজি করে বাড়তি দামের লেবেল বোতলে লাগিয়ে বিক্রি করেছেন দিনের পর দিন।
রাজধানীতে নানান উদ্যোগের মধ্যেও নতুন দাম খুব একটা কার্যকর করা যায়নি। মফস্বলের চিত্র আরও ভয়ংকর। বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে নতুন দরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দেখা মেলেনি। বাজারে এসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। কম দামের সয়াবিন কিনতে এসে তারা রীতিমতো হতাশ। তাদের প্রশ্ন, সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে লাভ কী হলো?
খুচরা বাজারে তিনটি দোকান ঘুরেও নতুন দামে কোথাও সয়াবিন তেল পাননি স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, ‘অনেক দোকান ঘুরেও ১৮৫ টাকা লিটার লেখা বোতলজাত সয়াবিন তেল পেলাম না। দোকানিরা বলছেন, নতুন দামের তেল এখনও আসেনি। আগের দামে হলে তেল নিতে পারেন।’
সোহরাবের ভাষ্য, এটি এক ধরনের প্রতারণা। তারা বেশি দামে তেল বিক্রির জন্যই এগুলো করছেন, এ বিষয়ে প্রশাসনের নজর রাখা উচিত।’
মুদি দোকানি সেকেন্দার আলী জানান, তিনি এক লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। কারণ, আগে থেকে কিনে রাখা তেল বিক্রি এখনও শেষ হয়নি। পাশের আরেক দোকানি সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
সয়াবিন তেল কিনতে আসা ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ধাপ্পাবাজির আর শেষ নেই। তারা বলছেন, আগে বেশি দামে কিনেছেন, তাই এখন বেশি দামে বিক্রি করছেন। এতে সরকারি নির্দেশনার দাম থাকলো কই?’