আশুরার করণীয় ও বর্জনীয়

48

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

আল্লাহ তা’আলা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই বারো মাসে বছর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই মাস সমূহের মধ্যে প্রথম মাস হল মহররম মাস। মহররম মাসের সাথে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত আছে। এই মাসে রয়েছে কিছু সুন্নাত ইবাদত। আবার এই মাসকে কেন্দ্র করে সমাজে কিছু কুসংস্কার ও সুন্নাহ বিরোধী আমল প্রচলিত আছে। ইসলামী শরী’আতের আলোকে মহররম মাসের অনেক ফযীলত রয়েছে।
চারটি হারাম তথা সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম হল মহররম। মহান আল্লাহ বলেন-‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাসসমূহের গণনা হল বারোটি। যার মধ্যে চারটি মাস হল ‘হারাম’ (মহাসম্মানিত)। আবূ বাকরাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা:) বলেন- ‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা’দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মহররম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হল রজব-ই-মুযার। যা জুমাদা ও শা’বান মাসের মাঝে অবস্থিত’। আবূ হুরায়রাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- ‘রমজান মাসের পর আল্লাহর মাস মহররমের সিয়াম হচ্ছে সর্বোত্তম এবং ফরজ সালাতের পর রাতের সালাতই সর্বোত্তম’। এই মাস আল্লাহর মাস : বছরের সব মাস আল্লাহর হলেও মহররমকে আল্লাহ নিজের মাস বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আরবী ‘আশারা শব্দ থেকে এসেছে ‘আশুরা ‘আশারা অর্থ দশ আর ‘আশুরা অর্থ দশম, মাসের দশম দিন। হিজরী সনের প্রথম মাস মহররমের দশ তারিখকে আশুরা বা আশুরায়ে মহররম বলা হয়। আশুরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বিভিন্ন আমলের প্রচলন দেখা যায়। যার সবগুলো ইসলাম সমর্থন করে না। মহররম মাস বছরের চারটি হারাম মাসের অন্যতম। অন্যান্য হারাম মাসের ন্যায় এ মাসে বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থেকে এ মাসকে সম্মান করতে হবে। আবূ জামরাহ (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু আববাস (রা:)-এর সাথে বসতাম। তিনি আমাকে তাঁর আসনে বসাতেন। একবার তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে থেকে যাও, আমি তোমাকে আমার ধন-সম্পদ হ’তে কিয়দংশ প্রদান করব। আমি তাঁর সাথে দু’মাস থাকলাম। অতঃপর একদা তিনি বললেন, আব্দুল কায়েস গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল আল্লাহর রাসূল (সা:)-এর নিকট আগমন করলে তিনি বললেন, তোমরা কোন গোত্রের? কিংবা বললেন, কোন প্রতিনিধি দলের? তারা বলল, ‘রাবী‘আ গোত্রের’। তিনি বললেন, স্বাগতম সে গোত্র বা সে প্রতিনিধি দলের প্রতি, যারা অপদস্থ ও লজ্জিত না হয়েই আগমন করেছে। তারা বলল- ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! হারাম মাস ব্যতীত অন্য কোন সময় আমরা আপনার নিকট আগমন করতে পারি না। আমাদের এবং আপনার মধ্যে মুযার গোত্রীয় কাফেরদের বসবাস। তাই আমাদের কিছু স্পষ্ট নির্দেশ দিন, যাতে করে আমরা যাদের পিছনে ছেড়ে এসেছি তাদের অবগত করতে পারি এবং যাতে করে আমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারি’। সিয়াম পালন করা : এ মাসের অন্যতম কাজ হল এ মাসের দশ তারিখে সিয়াম পালন করা। রাসূলুল্লাহ (সা:) মক্কাতে অবস্থান কালে এ সিয়াম পালন করতেন। মক্কার কুরায়শরাও এই দিনকে সম্মান করত ও সিয়াম পালন করত। আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘জাহেলী যুগে কুরায়শরা আশুরার সিয়াম পালন করত এবং আল্লাহর রাসূল (সা:)ও এ সিয়াম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় আগমন করেন তখনও এ সিয়াম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমজানের সিয়াম ফরজ করা হল তখন আশুরার ছিয়াম ছেড়ে দেয়া হল। যার ইচ্ছা সে পালন করবে, আর যার ইচ্ছা পালন করবে না’। মদীনায় হিজরতের পর তিনি এ সিয়াম পালন করতেন ও ছাহাবায়ে কেরামকে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘নবী করীম (সা:) মদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সিয়াম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সিয়াম পালন কর কেন?) তারা বলল, এটি অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেছেন। ফলে এ দিনে মূসা (আ:) সিয়াম পালন করতেন। রাসূল (সা:) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে সিয়াম পালন করেন এবং (লোকদেরকে) সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন’। রমজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ (সা:) মহররম মাসের দশ তারিখে সিয়াম পালনে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। ছাহাবীগণও আশুরার সিয়াম পালনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন। রুবাইয়ি‘ বিনতু মু’আবিবয (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আশুরার সকালে আল্লাহর রাসূল (সা:) আনছারদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেনি সে যেন দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকে। আর যার সিয়াম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন সিয়াম পূর্ণ করে। তিনি (রুবাইয়ি‘) (রা:) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন সিয়াম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের সিয়াম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন তারা আমাদের কাছে খাবার চাইত, আমরা তাদের খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম যতক্ষণ না তারা তাদের সিয়াম পূর্ণ করত’। ইবনু আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা:)-কে ‘আশুরার দিনের সিয়ামের উপরে অন্য কোন দিনের সিয়ামকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রমজান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)। আল-হাকাম ইবনুল আ’রাজ (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রা:)-এর নিকট এলাম। এ সময় তিনি মাসজিদুল হারামে তার চাদরে হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি তাকে আশুরার সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যখন তুমি মহররমের নতুন চাঁদ দেখবে, তখন থেকে গণনা করতে থাকবে। এভাবে যখন নবম দিন আসবে তখন সিয়াম অবস্থায় ভোর করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মুহাম্মাদ (সা:) কি এভাবে সিয়াম রাখতেন? তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সা:) এভাবেই সিয়াম রাখতেন’। আশুরার সিয়াম পালন করা সুন্নাত। হুমাইদ ইবনু আব্দুর রহমান (রহ:) থেকে বর্ণিত, যে বছর মুআবিয়া (রা:) হজ¦ করেন, সে বছর আশুরার দিনে (মসজিদে নববীর) মিম্বরে তিনি (রাবী) তাঁকে বলতে শুনেছেন যে ‘হে মদীনাবাসীগণ! তোমাদের আলিমগণ কোথায়? আমি আল্লাহর রাসূল (সা:)-কে বলতে শুনেছি যে, আজকে আশুরার দিন, আল্লাহ তা’আলা এর সিয়াম তোমাদের উপর ফরজ করেননি বটে, তবে আমি সিয়াম পালন করছি। যার ইচ্ছা সে সিয়াম পালন করুক, যার ইচ্ছা সে পালন না করুক’। রাসূলুল্লাহ (সা:) এ দিনের সিয়ামকে বেশী প্রাধান্য দিতেন। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আমি নবী করীম (সা:)-কে আশুরার দিনের সিয়ামের উপরে অন্য কোন দিনের সিয়ামকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রমজান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)’। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘নবী করীম (সা:) রমজানের সিয়ামের পর আশুরার দিন ছাড়া কোন দিনকে অন্য দিন অপেক্ষা মাহাত্ম্যপূর্ণ মনে করতেন না’। এক বছরের গুনাহের কাফফারা : আশুরার সিয়াম পূর্ববর্তী এক বছরের ছগীরা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আবু ক্বাতাদাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- ‘আর আশুরার সিয়াম, আমি আশা করি (এর বিনিময়) বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে’। অন্য শব্দে এসেছে, ‘বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন’। রাসূলুল্লাহ (সা:) মক্কায় ও মদীনায় প্রথম দিকে মহররম মাসে এক দিন সিয়াম পালন করতেন। পরবর্তীতে ইহুদীদের বিরোধিতা করার জন্য ৯ তারিখসহ দুই দিন সিয়াম পালনের আশা প্রকাশ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা:) যখন নিজে আশুরার দিন সিয়াম রাখলেন এবং আমাদেরকেও এ সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! ইহুদী ও খৃষ্টানরা এ দিনটিকে সম্মান করে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন- ‘আগামী বছর আসলে আমরা নবম দিনেও সিয়াম পালন করব। কিন্তু আগামী বছর না আসতেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যুবরণ করেন’। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত- ‘তোমরা ৯ ও ১০ তারিখে সিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের বৈপরীত্য কর’। সুতরাং মহররমের দু’টি সিয়াম পালন করা উত্তম। এক্ষেত্রে দশ তারিখের আগের দিন বা পরের দিন সিয়াম রাখা যেতে পারে। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত- ‘তোমরা আশুরার সিয়াম পালন কর এবং ইহুদীদের বিরোধিতা করা। তোমরা আশুরার আগের দিন অথবা পরের দিন সিয়াম পালন কর’। আল্লাহ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্যতম হল ফেরাউনের জাতি। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াতের জন্য মূসা (আ:) ও তাঁর ভাই হারূন (আ:)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। আর আসমানী কিতাব তাওরাত নাযিল করেন। মূসা (আ:)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই বণী ইসরাঈলের উপর ফেরাউন অত্যাচার করত। ফেরাউন নিজেকে ইলাহ দাবী করল এবং মূসা (আ:)-এর কওমের উপর অত্যাচার আরো বৃদ্ধি করে দিল। ফলে মূসা (আ:) আল্লাহর আদেশে একরাতে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সমুদ্র বাধা হয়ে দাঁড়াল। আল্লাহ মূসাকে লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করার আদেশ দিলে সাগর ভাগ হল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল’ সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ফেরাউন তাদের পিছনে ধাওয়া করল। আল্লাহ মূসা ও তাঁর জাতিকে আল্লাহ রক্ষা করলেন আর ফেরাউন ও তার জাতিকে পানিতে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করলেন আল্লাহ বলেন- ‘আর আমরা বনী ইস্রাঈলকে সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি বশে। অতঃপর যখন সে ডুবতে লাগল তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনলাম এই মর্মে যে, কোন উপাস্য নেই তিনি ব্যতীত যার উপরে বনী ইস্রাঈলগণ ঈমান এনেছে। আর আমি তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (আল্লাহ বললেন) এখন? অথচ ইতিপূর্বে তুমি অবাধ্যতা করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। এই মহান দিনটি ছিল মহররম মাসের দশ তারিখ তথা আশুরার দিন। ইহুদীরা এই দিনকে সম্মান করত ও গুরুত্ব দিত। আবূ মূসা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আশুরার দিনকে ইহুদীগণ ঈদ (উৎসবের দিন) মনে করত। নবী করীম (সা:) (ছাহাবীগণকে) বললেন, তোমরাও এ দিনের সিয়াম পালন কর’। আবূ মূসা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘খায়বারের ইহুদীরা আশুরার দিন সিয়াম পালন করত। তারা এ দিনকে ঈদরূপে বরণ করত এবং তারা তাদের মহিলাদেরকে অলংকার ও উত্তম পোষাকে সুসজ্জিত করত। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তোমরাও এ দিনে সিয়াম পালন কর’। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য উদার হস্তে খরচ করবে আল্লাহ তা‘আলা সারা বছর উদারহস্তে তাকে দান করবেন। সুফিয়ান ছাওরী বলেন, আমরা এর পরীক্ষা করেছি এবং কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি’। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত- ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে ইছমিদ নামক পাথরের সুরমা ব্যবহার করবে, সে কখনও ঝাপসা দেখবে না’। আরেকটি বর্ণনা- ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে সে এই বছর রোগাক্রান্ত হবে না। আর যে ব্যক্তি আশুরার দিন চোখে সুরমা লাগাবে তার এই বছর চোখের কোন রোগ হবে না’। ইবনু তায়মিয়া (র:) বলেন, আমাদের কোন আলেম আশুরার দিন গোসল করাকে পসন্দ করতেন না এবং চোখেও সুরমা লাগাতেন না। আর রাসূল (সা:)ও এরূপ করেননি। এরূপ করেননি আবু বকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রা:)ও। আবূ হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত- ‘আশুরা হল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের ঈদের দিন। সুতরাং তোমরা এই দিন ছিয়াম পালন কর’। ‘যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার জন্য সত্তর বছরের সিয়াম ও ক্বিয়ামের নেকী লিখে দিবেন। যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে তার জন্য দশ হাযার ফেরেশতার সমান ছওয়াব দেওয়া হবে। আর যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে তাকে হজ¦ ও ওমরার সওয়াব দেওয়া হবে’। এছাড়াও ওয়াজ-মাহফিলে, জুম্মার খুৎবায় বিভিন্ন আলোচকের মুখে আশুরাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা শোনা যায়। যার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কোন মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুর খবরে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করে তার জন্য দোয়া করা, তার জানাযা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা অন্য মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। আর তার মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালন করা যাবে। যদিও তারা পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে হয়। তবে স্ত্রী স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবেন এবং বিবাহ, সাজগোজ থেকে বিরত থাকবেন’। যায়নাব বিনতু আবূ সালামা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন সিরিয়া হতে আবূ সুফিয়ান (রা:)-এর মৃত্যুর খবর পৌঁছল, তার তৃতীয় দিবসে উম্মু হাবীবা (রা:) হলুদ বর্ণের সুগন্ধি আনয়ন করলেন এবং তাঁর উভয় গন্ড ও বাহুতে মাখলেন। অতঃপর বললেন, অবশ্য আমার এর কোন প্রয়োজন ছিল না, যদি আমি নবী করীম (সা:)-কে এ কথা বলতে না শুনতাম যে- ‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ এবং ক্বিয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে স্বামী ব্যতীত অন্য কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা বৈধ নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে’। কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ বা শাহাদতবরণ করলে তার জন্য মৃত্যুবার্ষিকী পালনের বিধান ইসলামে নেই। রাসূল (সা:) ও ছাহাবায়ে কেরাম কখনো কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেননি। হোসাইন (রা:)-এর শাহাদত বরণের মর্মান্তিক ঘটনাটিও আশুরার দিনে অর্থাৎ ১০ মুহাররম ঘটেছিল। যা মুসলমানদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য সেদিন শোক দিবস হিসাবে পালন করা শরীআত সম্মত নয়। আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুকতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩ হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃ.) তার শক্তিশালী শী‘আ আমীর মু‘ইযযুদ্দৌলা হুসায়েন (রা:)-এর শাহাদতের স্মরণে ৩৫২ হিজরীর ১০ মহররমকে ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন। তিনি মহিলাদের শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাঁথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহরে ও গ্রামে সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারী হলে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে। আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে অনেকে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে বিলাপ করেন, বুক চাপড়ান ও মাথায় কালো কাপড় বেঁধে শোক প্রকাশ করেন, যা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবীরা গুনাহ। সকল আলেম একমত যে, আওয়াজ করে মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করা জায়েয নয়। আবূ হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে দু’টো আচরণ এমন পাওয়া যায়, যা তাদের ক্ষেত্রে কুফরীমূলক কর্ম; বংশে খোঁটা দেওয়া ও মৃতের জন্য মাতম করে কান্না করা’। আবূ বুরদাহ, ইবনু আবূ মূসা (রহ:) থেকে বর্ণিত, একবার আমার পিতা আবূ মূসা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এতে (আমার বিমাতা) তাঁর স্ত্রী আব্দুল্লাহর মা বিলাপ করতে লাগল। অতঃপর তিনি সংজ্ঞা লাভ করলেন এবং আব্দুল্লাহর মাকে বললেন, তুমি কি জানো না? তারপর তিনি একটি হাদিস বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- ‘আমি তার সাথে সম্পর্কহীন যে মাথার চুল ছিঁড়ে, উচ্চেঃস্বরে বিলাপ করে এবং জামার গলা ফাঁড়ে’। মর্ছিয়া করা : মর্ছিয়া আরবী শব্দ। এর অর্থ- শোকগাঁথা, শোকসঙ্গীত। আমাদের সমাজে কারবালার ইতিহাসকে নিয়ে বিভিন্ন রকম কবিতা, জারী গান, বিভিন্ন নভেল-নাটক ও গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। যার অধিকাংশ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। যেখানে ইয়াজিদ ও তার পিতা বিশিষ্ট ছাহাবী মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রা:)-কে হেয় করা হয়েছে। মীর মোশাররফ হোসেন কর্তৃক রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’কে কারবালার ইতিহাস গ্রন্থ মনে করা হয়। অথচ এই উপন্যাসের অধিকাংশ তথ্যই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইসলামে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এ সকল কার্যকলাপ কখনো জায়েয নয়। তাযিয়া শব্দের অর্থ- সান্তবনা দান, শোক প্রকাশ। আশুরার দিন হোসাইন (রা:)-এর কাল্পনিক কবর তৈরী করে তা‘যিয়া বা শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভুয়া কবরগুলিকে ‘আত্মা সমূহের অবতরণস্থল’ বলে ধারণা করা হয়। সেখানে হোসাইনের রূহ হাজির হয় কল্পনা করে তাকে সালাম দেওয়া হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা হয়। এগুলো স্পষ্ট শিরক। তা‘যিয়া-মাতম বর্জন করে তাদের জন্য দো‘আ করা উচিত। আশুরার দিন অনেকে হোসাইন (রা:)-এর মৃত্যুকে স্মরণ করে, তার শোকে বিভিন্ন ধারালো জিনিস দিয়ে নিজের দেহকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে এবং নিজের গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা:) ইরশাদ করেছেন- ‘যারা শোকে মুখে চপেটাঘাত করে, জামা ছিন্ন করে ও জাহিলী যুগের মত চিৎকার করে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’। হোসাইন (রা:)-এর বড় ভাই হাসান (রা:) নিহত হয়েছিলেন, তার পিতা আলী ইবনে আবু তালিব শাহাদত বরণ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে এরকম অনেক দুঃখজন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মুসলমানরা কারো জন্যই এ রকম শোক পালন করেন না। আশুরার দিন হাসান-হোসাইন (রা:)-কে মর্যাদা দিতে গিয়ে অনেকে কোন কোন সাহাবী-তাবেঈ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে থাকেন। এমনকি গালিও দিয়ে থাকেন। আয়েশা (রা:)-এর নামে একটি বকরী বেঁধে রেখে লাঠিপেটা ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করা হয়। এছাড়াও মু‘আবিয়া (রা:) ও তাঁর ছেলে ইয়াজিদকে কারবালার ঘটনার জন্য দায়ী করে গালি-গালাজ করে থাকেন। অথচ সাহাবীগণকে গালি দেওয়া বড় গুনাহের কাজ। আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন- ‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ ছওয়াব লাভ করতে পারবে না’। আশুরার নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন- সরকারী ছুটির ব্যবস্থা করা, রাস্তা-ঘাট বিভিন্ন রঙে সাজানো, লাঠি, তীর, বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া, হোসাইন (রা:)-এর নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বিক্রি করা ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠান পালনে অনেক টাকার অপচয় হয়, সময় নষ্ট হয় আর ইসলামের নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। অপরদিকে অনেকে এই মাসকে শোকের মাস ভেবে বিবাহ-শাদী করা, আশূরার দিনে পানি পান করা ও শিশুদেরকে দুধ পান করানোকেও অন্যায় মনে করেন। কারবালার ঘটনাকে অনেকে হক ও বাতিলের লড়াই বলে আখ্যায়িত করেন। তারা হোসাইনকে হক ও ইয়াজিদকে বাতিল বলে মনে করেন। এই বিশ্বাস ঠিক নয়। বিষয়টি ছিল ইজতিহাদী বিষয়, হক বাতিলের বিষয় ছিল না। কারণ হোসাইন (রা:)-কে হকপন্থী বলে মনে করলেও ইয়াজিদকে বাতিল বলা যাবে না। ইয়াজিদ মু‘আবিয়া (রা:)-এর যোগ্য সন্তান ছিলেন এবং মু‘আবিয়ার পরে তাকে খলীফা বানানোর জন্য সকল গভর্নর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালে জীবিত ৬০ জন সাহাবী ও ইসলামী বিশে^র নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই মেনে নিয়েছিলেন ও বায়‘আত করেছিলেন। হোসাইন (রা:) নিহত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনরূপ আন্দোলন গড়ে তুলেননি। আর তিনি প্রায় চার বছর (৬০-৬৪ হিঃ) মুসলিম সম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রথম দিকে কেবলমাত্র মদীনায় চারজন ছাহাবী বায়‘আত নিতে বাকী ছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের ও হুসায়েন ইবনু আলী (রা:)। প্রথমোক্ত দু’জন পরে বায়‘আত করেন। শেষোক্ত দু’জন গড়িমসি করলে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা:) তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন! মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না’। হোসাইন (রা:) কূফায় যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল কূফাবাসীর আগ্রহ ও তাঁর হাতে বায়‘আত করার জন্য লিখিত পত্র। শী‘আদের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে বর্তমানে হোসাইনের মাথা ছয়টি দেশে পূজিত হচ্ছে। ১. মদীনার বাক্বী‘ গোরস্থানে তাঁর মা ফাতেমা (রা:)-এর কবরের পাশে ২. দামেষ্কে হুসায়েনের মাথা বা মাসজিদুর রা’স সংলগ্ন গোরস্থানে ৩. মিসরের রাজধানী কায়রোতে। যা ‘তাজুল হুসায়েন’ বা হোসাইনের মুকুট নামে খ্যাত। এজন্য মিসরীয়রা নিজেদের দেশকে ‘আল্লাহর পসন্দনীয় দেশ’ বা Choosen country বলে গর্ববোধ করে। ৪. ইরানের মারভে। ৫. ইরাকের নাজাফে এবং ৬. কারবালা প্রান্তরে। কিন্তু এসব তথ্যগুলিতে কেউ একমত নন। পরিশেষে বলব, আশুরার সঠিক ইতিহাস এবং আশুরার শরী‘আত সম্মত করণীয় সমূহ পালন করতে হবে। আর এ সম্পর্কিত সকল বিদ‘আত পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন! লেখক : বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও গবেষক।