ইউজিসির ৪৬ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে ক্ষুব্ধ সংসদীয় কমিটি

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো, শিক্ষার মান ও গবেষণাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন বিষয়ক ৪৬টি প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আওতাধীন এসব প্রকল্পের সবগুলোরই ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি পুরোটাই সমান। এ বিষয়টিকে অসম্ভব বলে মনে করছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির মনে করে, ‘টেবিল মেড’ প্রতিবেদন তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে কমিটি। একইসঙ্গে সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া এবং বারবার সময় বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ আগষ্ট) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের কার্যপত্র থেকে দেখা যায়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে ৪৬টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে ৮টি, ৫০ শতাংশের নিচে ১৬টি এবং ৫১ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে আছে ২২টি।
কমিটির বৈঠকে ইউজিসির উপস্থাপিত তথ্য থেকে দেখা গেছে, চলমান প্রকল্পের সবগুলোরই ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি হুবহু এক। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কমিটির সদস্যরা আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি সমান হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা অভিমত দেন ব্যতিক্রম দু-একটির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সমান হলেও সবগুলোর ক্ষেত্রে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিবেদন না করে টেবিলে বসে এটা করা হয়েছে বলেও কমিটির সদস্যরা মন্তব্য করেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করলে তারা কমিটির বৈঠকে কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি বলে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ না করে বারবার সময় ও ব্যয় বাড়ানোর বিষয়টি নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে কমিটি। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বাস্তবায়নে সফলতা না থাকলেও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিদেশ যাওয়া এবং গাড়ি কেনার প্রবণতার বিষয়টিও উঠে আসে বৈঠকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি আব্দুস শহীদ বলেন, ‘আমরা ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি একই হওয়ার বিষয়টি ইউজিসির কাছে জানতে চেয়েছিলাম। এটা কী করে সম্ভব হলো, তারা সেটা জানাতে পারেনি। তারা কোনও জবাব দিতে পারেনি। তাদের কর্মকাণ্ডে গাফিলতি রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। আর এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডগুলো গতিশীল হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সার্বিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে সব প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা নিরূপণ করে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমরা একটি বিষয় খুব বেশি দেখি, সেটা হলো প্রকল্প হলেই গাড়ি কেনার দিকে ঝোঁক বেশি থাকে। বাস্তব কোনও অগ্রগতি নেই। কিন্তু আর্থিক ব্যয় বেশি। সার্বিক মিলিয়ে আমাদের একটি দৈন্যদশা মনে হয়েছে। কোনোটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।’
কমিটি যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করতে বলেছে উল্লেখ করে সাবেক এই চিফ হুইপ বলেন, ‘আমরা বলেছি, যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ার কারণে সরকারের যে আর্থিক ক্ষতি ও অর্থের ওপর চাপ পড়ে, তার দায় কে নেবে? এজন্য আমরা ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুশাসন দিয়েছি।’
কার্যপত্রে দেখা গেছে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি দুটোই সমান। এর অগ্রগতি হয়েছে ২২.৯৩ শতাংশ। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৭২.৩৬ শতাংশ। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৫২.৬৫ শতাংশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ০.৩৩ শতাংশ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৫৬.৮২ শতাংশ। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ২৬.০২ শতাংশ। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪৭.২৩ শতাংশ। বুয়েটের শিপ মডেল টেস্টিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৯.৯৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩৪.৪৫ শতাংশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪২.৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ১০.৩৯ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৮২.৬৮ শতাংশ। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩৪.৭১ শতাংশ। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৬৩.০৭ শতাংশ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৯.০৬ শতাংশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩৭.১৬ শতাংশ। নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ১৪.৫৬ শতাংশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪৪.৫৫ শতাংশ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪৩.৩৬ শতাংশ। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৬৮.০৪ শতাংশ। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ২৭.৪৮ শতাংশ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ২৫.৬৫ শতাংশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩৪.১৪ শতাংশ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ২৭.১০ শতাংশ। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৬৩.৩৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ১৫.৭২ শতাংশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯০.১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৫৯.১৭ শতাংশ। বুয়েটের ইনকিউবেটর স্থাপন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৭৮.১৭ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ১০.৮৬ শতাংশ। কলেজে এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩৭.৪৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৪.৪৮ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সমীক্ষা প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ২৬.২২ শতাংশ। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৭৯.৫৫ শতাংশ। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯২.৭১ শতাংশ। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৬৭.৮৭ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৬.৯৪ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৬৫.২৫ শতাংশ। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৩.৮৭ শতাংশ। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৮.৬৫ শতাংশ। ঢাবির পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৯.০৯ শতাংশ। টেক্সটাইল বিষয়ে জার্মান-বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা বিষয়ক প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪.০৮ শতাংশ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৭.২০ শতাংশ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৪৭.২৬ শতাংশ। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ।
এদিকে সময় মতো কাজ শেষ করতে না পারা কয়েকটি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিতে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নেওয়া প্রকল্পটি গত ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ২৬ শতাংশ। আঞ্চলিক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মূল মেয়াদ শেষ হয় গত ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি ৩.২০ শতাংশ। অবশ্য ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া এ প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজারে স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের সময়সীমা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর। কিন্তু এটির কাজও হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। এই প্রকল্পটির মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যানবেইসের এস্টাবলিশমেন্ট অব ইনটিগ্রেডেট এডুকেশন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল গত ৩০ জুন। কিন্তু এর কাজের অগ্রগতি ৫২ শতাংশ। ব্যানবেইসের আরেকটি প্রকল্পের মূল মেয়াদ গত এপ্রিলের শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বশেষ তথ্যমতে, এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ২০ শতাংশ। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি দুটোই সমান। অবশ্য প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের আরও কিছু প্রকল্পের তথ্য মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।