গোয়াইনঘাট মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, অনিয়মই যেখানে নিয়ম-তদন্ত

8

গোয়াইনঘাট থেকে সংবাদদাতা :
সিলেটের গোয়াইনঘাটের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে যেন অনিয়মই নিয়ম। অনিয়ম অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পরিণত হলেও দেখার কেউ নেই। শিক্ষকদের নানা কাজে হয়রানি, বিলম্বিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। কর্মরত কর্মচারীদের কাছে বদলী নামক চ্যাপটার নেই বললে চলে। ব্যাপারটা যেন রুপকথার গল্প। তাই এই অফিসেই কেউ কর্মরত আছেন ১৫-১৬ আবার কেউ আছেন একটানা ২৩-২৫ বছর থেকে। কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো। আর এ কারণে কোন অবৈধ খাতের ভাগবাটোয়ারাও হয় সুশৃঙ্খলভাবে। এ অফিসের রক্ষিত সরকারের বরাদ্দকৃত সম্পদ চুরি করে তসরুপও করা হয়।
দীর্ঘদিন থেকে চুরিসহ অনিয়মের ঘটনা ঘটে আসলেও কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়না। অফিস সহায়ক কিংবা হিসাব রক্ষকের কাছে গোদামের সংরক্ষিত বইয়ের কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অফিস গোদাসহ জরুরি ফাইল সংরক্ষিত করে রাখা আলমারির চাবিও থাকে অফিসের জন্য নিযুক্ত নৈশপ্রহরীর কাছে। গোদাম থেকে সরকারের বরাদ্দকৃত এসব বই দীর্ঘদিন থেকে ছয় নয় ও চুরি করে বিক্রির ঘটনা ঘটলেও পারস্পরিক যোগসাজশ থাকায় কখনো ধরা পড়েনি চুরির কোন ঘটনা। কথায় বলে পাপ ছাড়ে না বাপকে!
গভীররাতে গোয়াইনঘাট থেকে পিকআপ যুগে চুরি করে মাধ্যমিকের একটি বইয়ের চালান সিলেটের কাজির বাজারে বিক্রির সময় ঘটে বিপত্তি! বেরসিক পুলিশ হাতেনাতে ধরে ফেলে বই চুর চক্রের হোতাকে।
জানা গেছে, ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দকৃত মাধ্যমিক সহগ্রাধিক বই খোলা বাজারে বিক্রয়কালে পিক-আপসহ জব্দ করেছে পুলিশ। শনিবার সকালে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার এলাকায় ওই পিকআপ থেকে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেনীর বইগুলো জব্দ করা হয়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আনোয়ার হোসেন নামের আরও এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
ধৃত আনোয়ার পুলিশকে জানান, তিনি গোয়াইনঘাটের মাধ্যমিক অফিস থেকে ২৭ হাজার টাকায় বইগুলো কিনেছেন। গোয়াইনঘাট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী শাহাব উদ্দিন এই বইগুলো তার কাছে বিক্রি করেছেন।
এ ঘটনায় সিলেটের মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং ৭৯ তাং ৩০/০৭/২২।
সিলেটের কোতোয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানিয়েছেন, পিকআপের চালকসহ দু’জনকে প্রায় দেড় হাজার কেজি বইসহ আটকের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানা পুলিশের সহায়তায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী শাহাব উদ্দিনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
আটকের পর গোয়াইনঘাট থানা জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে বই চুরির সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেছে।
এ বিষয়ে রোববার দুপুরে সরজমিন গোয়াইনঘাট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের বই গোদামে গেলে দেখা যায় পুরো গোদাম ঘরটিই যেন অরক্ষিত। দরজা জানালা পুরনো। ভাঙ্গা জানালার উপর নিরাপত্তায় পুরনো পচা ডেউটিন বেঁধে রাখা। ঘটনা জানার পর সরজমিন এসে সেই ভুতুড়ে গুদামে এসে বই গুননা করছেন একাডেমিক সুপারভাইজার শ্যামল কুমার রায়, অফিস সহায়ক শংকর পদ পালসহ কজন মাধ্যমিক শিক্ষক। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মতে এ অফিসেই ভয়ংকর বই চুর চক্র রয়েছে। যদি এমনটি নাই হতো তাহলে একাডেমিক সুপারভাইজার, অফিস সহায়ক, হিসাবরক্ষক থাকতে কিভাবে একজন নৈশপ্রহরীর কাছে বইয়ের গোদাম ও অফিসের বিভিন্ন সংরক্ষিত আসবাবপত্রের চাবি থাকে? সূত্র মতে অফিসের দায়িত্বশীলদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন থেকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের বই চুরি করে বিক্রিসহ না দুর্নীতি হয়ে আসছে। এই অফিসের কর্মচারীদের কেউ ২৩-২৫ আবার কেউ ১৫-১৬ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত। এদের হাত ধরেই দীর্ঘদিন থেকে বই চুরিসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা ঘটে থাকে। শিক্ষকদের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ, পেনশন ফাইল ডিলিংয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায়, হয়রানি নিত্যকার। সূত্রমতে ইতিপূর্বেও নানা অনিয়মের ঘটনায় গোয়াইনঘাট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। বই চুরির ঘটনায় শুধু সাহাব উদ্দিন জড়িত নয় দাবি সূত্রটির। সঠিক তদন্ত হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
সিলেট জেলা অফিস থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় বরাদ্দকৃত মাধ্যমিকের বইয়ের পরিসংখ্যান কতো, চুরি হয়েছে কতটি মোবাইল ফোনে এমন প্রশ্নে সদুত্তর পাওয়া যায়নি হিসাবরক্ষক সাহাদাত হোসেনের কাছে, বিষয়টি তিনি পরে জানাবেন বলেই ফোন কেটে দেন।
নিজেদের বইয়ের গোদাম থেকে বই চুরির ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়াইনঘাটের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার শ্যামল কুমার রায় কোন রকম তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন আমি শিক্ষা অফিসের চার্জে নেই। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এখানকার অতিরিক্ত দায়িত্বে, তাকে ফোন দিন। আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারবো না।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিলুর রহমান বলেন, গোদাম থেকে মাধ্যমিকের বই চুরি ও আটকের ঘটনা শুনেছি। বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। তদন্ত শেষ হলে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
সিলেটের জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আবু সাইদ মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, বিষয়টি জানার পর জড়িত নাইটগার্ড সাহাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এবং এই ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের ১টি তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু হয়েছে।