লোডশেডিং করে লাভের খাতা শূন্য ॥ বেড়েছে জেনারেটর ও আইপিএসের ব্যবহার

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটের প্রভাবে নাজেহাল দেশের বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত হচ্ছে কম বিদ্যুৎ। এমন অবস্থায় লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সাশ্রয় নীতি হাতে নিয়েছিল সরকার। এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে থাকা এই নীতি একেবারেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যে পরিমাণ সাশ্রয় হওয়ার আশা করা হয়েছিল তার ধারে-কাছেও পৌঁছায়নি। বরং লোডশেডিংয়ের ফলে বেড়েছে ডিজেলচালিত জেনারেটরের ব্যবহার।
বেড়েছে আগের মতো করে আইপিএসের ব্যবহারও। ফলে পরিস্থিতি যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই রয়েছে। তবে পর্যবেক্ষণকালীন এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনি নতুন কোন সিডিউল দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
সরকার ঘোষিত সাশ্রয়ী নীতি প্রয়োগের প্রথমদিন অর্থাৎ ১৯ জুলাই যেমন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশি সাশ্রয় হয়নি তেমনি সপ্তাহ শেষে অর্থাৎ গত মঙ্গলবারও সাশ্রয় হয়েছে ৫০০ মেগাওয়াটই। তাই এই প্রক্রিয়াকে সাশ্রয়ের উপযুক্ত পদ্ধতি নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বরং প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত সরকার ঘোষিত লোডশেডিংয়ের ফলে জনজীবনে যেমন নেমে এসেছে দুর্ভোগ, তেমনি বেড়েছে ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির ব্যবহারও।
প্রতিদিন অন্তত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত ১৮ জুলাই দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যা ১৯ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। সরকারের নেয়া ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার কথা ছিল। তাও পিক আওয়ারে অর্থাৎ বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে।
কিন্তু গত প্রায় ১০ দিন যাবত রাজধানীসহ সারাদেশেই দিনভর লোডশেডিংয়ের কবলে নাজেহাল হতে হয়েছে সাধারণ মানুষজনকে। বেশিরভাগ জায়গাই দফায় দফায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুতহীন অবস্থায় ছিল। মফস্বল এলাকাগুলো থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন।
ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের বাজারের অস্থিরতার কারণে স্পট মার্কেট থেকে উচ্চ মূল্যে কেনা বন্ধ রাখায় জ্বালানি সঙ্কটে বাধ্য হয়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুত উৎপাদন। এমন অবস্থায় প্রথমে বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে দাম বাড়ানোর চিন্তা করা হলেও ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে রেশনিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরী সভা থেকে জানানো হয়, বিদ্যুত সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে যাচ্ছে দেশ। সরকারী-বেসরকারী অফিস ভার্চুয়ালি করারও সিদ্ধান্ত হয়। শুধু তাই নয় পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সপ্তাহে একদিন বন্ধ পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার। রাত আটটার পর দোকান-পাট, শপিংমল বন্ধ না করলে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়া হয়।
কিন্তু সপ্তাহ শেষে এসব সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যায়। প্রথম প্রথম দোকান-পাট, শপিংমলগুলোতে নির্দেশনা মানা হলেও দুই-তিন দিন পরেই শুরু হয় আগের মতো সব। সরকারী অফিস-আদালতের বেশিরভাগ সভাই হয়েছে স্ব-শরীরে। মাঝখান থেকে শুধু লোডশেডিংয়ের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষজনকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এসব কথা স্বীকারও করেছে বিদ্যুত বিভাগ। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এক সপ্তাহ আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি।
যদিও লোডশেডিং করে আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে তেলের ব্যবহার কমাতে পেরেছি, কিন্তু বেড়েছে জেনারেটরে ডিজেলের ব্যবহার। আইপিএসের কারণে বেশি বিদ্যুৎ’ও ব্যবহার হয়েছে। মানুষজনের মধ্যেও সাশ্রয়ের প্রবণতা তেমন একটা নেই। ফলে আমরা ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারিনি। আজ (গত বুধবার) আমরা আমাদের সব স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে একটি রিভিউ মিটিং করেছি। সবার কাছ থেকে সাশ্রয়ের সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যার জন্য যতটুকু বরাদ্দ ঠিক ততটুকুই বিদ্যুত যেন ব্যবহার করে। লোডশেডিং ম্যানেজমেন্ট কিভাবে করতে হবে তারও পর্যালোচনা হয়েছে। পিডিবিকে বলা হয়েছে উৎপাদন বাড়াতে।
লোডশেডিং দিয়ে আমরা ২০০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় করতে পারলেও দোকান-পাটসহ অন্যান্য খাতে ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুত সাশ্রয় হয়নি। দেখি আরও দুই-একদিন। তারপর নিশ্চয়ই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে লোডশেডিংয়ের রি-সিডিউল হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র মতে জানা যায়, গত ২ জুলাই সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২৭৪০.৬ মেগাওয়াট। এর প্রেক্ষিতে উৎপাদন হয় ১২২৪০.৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এদিন চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের ঘাটতি হয় ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। একইভাবে ৩ জুলাই ১২০৪৬.২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা। এরই প্রেক্ষিতে উৎপাদন হয় ১১৫৪৬.২ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এদিন ঘাটতি দাঁড়ায় ৫শ’ মেগাওয়াট।
এরপরের ৩-৪ জুলাই চাহিদা ছিল ১২৯৪৭.৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের, উৎপাদন হয় ১১৫৪৭.৬ মেগাওয়াট। এদিন ঘাটতির পরিমাণ এক লাফে গিয়ে দাঁড়ায় ১৪শ’ মেগাওয়াটে। এই তিনদিন নগরবাসীকে লোডশেডিংয়ের কারণে পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ।
যতদিন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম স্থিতিশীল হচ্ছে না বা সরকারের পক্ষ থেকে তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি না দেয়া হচ্ছে। অথবা তেলের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। লোডশেডিংই হোক আর তেলের দাম বাড়ানোই হোক জনগণকেই ভুক্তভোগী হতে হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুত সরবরাহ বিঘ্ন্ন্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। তবে এখনই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসছে না।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, মূলত স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম বাড়ায়ই আমাদের এ সঙ্কট। যা খুব বেশি না। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেশি হওয়ায় আমরা আপাতত এলএনজি কিনতে পারছি না। কিনলে অনেক বেশি লোকসান দিতে হবে।
যতদিন দাম না কমে অথবা দেশীয় উৎপাদন না বাড়ে ততদিন লোড ম্যানেজমেন্ট করেই আমাদের চলতে হবে। আমরা সবাই জানি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির বাজার এখন অস্থির। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থা আলাদা নয়। সুতরাং পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে এটি রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয় দাবি করে তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। শ্রীকাইলে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছি। চলতি বছরের মধ্যে সেখান থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।
এছাড়া এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর আমরা ৫৬টি কার্গো আমদানি করছি। এ বছরও তাই। এই মাসেও দুইটি কার্গো এসেছে। তবে আমাদের সাশ্রয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। বিশ্বের সবগুলো দেশ এখন জ্বালানি সঙ্কটে দিন পার করছে। তাই আমাদের কৃচ্ছ্রতা সাধনের বিকল্প নেই।
পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২৫,৫৬৬ মেগাওয়াট। ৪ কোটি ২৯ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুত দিতে সঞ্চালন লাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৫৪৪ কিলোমিটার। বিতরণ লাইন রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার কিলোমিটার।
কৃচ্ছ্রতা সাধনের জন্য লোডশেডিং একমাত্র উপায় কি না জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন তার তুলনায় কম পাচ্ছি। আগে যেখানে গড়ে ১৪০০-১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত সেখানে এখন ১ হাজারের নিচে পাচ্ছি। আপাতত তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালিয়ে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এতে খরচ অত্যন্ত বেশি। বিদ্যুতের সাশ্রয়ে আমরা ইতোমধ্যে ৮টার মধ্যে দোকান-পাট বন্ধের নির্দেশনা জারি করেছি।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই আমাদের আপাতত সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া সঙ্কট কাটানোর সুযোগ নেই। সারাবিশ্বের মতো আমাদেরও এখন সাশ্রয়ী হতে হবে। যতটা সম্ভব অপচয় বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, একদিকে করোনার একটা অভিঘাত, তার ওপরে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যার ফলে আজ পুরো বিশ্বেই যেমন তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি অনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। বিদ্যুত আমরা সবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং সবাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাচ্ছিল। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুতের উৎপাদনের যে উপকরণগুলো সেগুলোর দাম অত্যাধিক বেড়েছে। এ অবস্থায় আমাদের অপচয় বন্ধ না করলে হবে না।
পেট্রোবাংলার এক হিসেব মতে, গত ২৯ জুন দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল ৩ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট। তাতে আমদানি করা গ্যাস অর্থাৎ এলএনজি ছিল ৮৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এরপর থেকে প্রতিদিনই গ্যাস সরবরাহ একটু একটু করে কমানো হয়েছে। গত সোমবার গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ২ হাজার ৮২২ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে এলএনজি ৫০৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিন দেশে বিদ্যুত উৎপাদনে ৯১৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি জানিয়েছে, সব মিলিয়ে এখনও তাদের ৩০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুত ঘাটতি হচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে এলাকাভেদে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঢাকা বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, সব মিলিয়ে আমাদের চাহিদা ১৬শ’ থেকে সাড়ে ১৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত। কিন্তু এখন আমরা ১২শ’র মতো পাচ্ছি। পিক আওয়ারে এই সঙ্কট আরেকটু বেশি হচ্ছে। প্রায় ৪শ’ থেকে দুই-আড়াইশ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সঙ্কট হচ্ছে। কবে নাগাদ এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন কোন খবর আপনাদের কাছে আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে তো বলা হচ্ছে গ্যাসের সঙ্কটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কবে নাগাদ উন্নতি হবে তা আসলে এখনি বলা যাচ্ছে না।
একই কথা বললেন ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমির আলী। আমাদের ঘাটতির পরিমাণ ১৫০ থেকে ১৭৫ মেগাওয়াটের মতো। চাহিদা থাকে ১০০০ মেগাওয়াট। সকালে পেয়েছি ৮৫০ মেগাওয়াট। এখন মানে দুপুরের দিকে চাহিদা কিছুটা বেশি হওয়ায় লোডশেডিং বাড়বে।