জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ হায় হায় পার্টির বিলাপে অগ্রগতি থামবে না

7
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনের লেকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা)- এসবের ফলে বিশ্বমন্দার পরিস্থিতি বিবেচনা না করে যারা ঢালাও সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশকে অচিরেই শ্রীলঙ্কার কাতারে এনে দাঁড় করাতে চান তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা নাই নাই, গেল গেল, হায় হায় করে বেড়াচ্ছে- এই হায় হায় পার্টি হায় হায় করতেই থাকুক। মাঝে মাঝে একটু তাদের তো বলতে দিতে হবে। আর আমরা আমাদের কাজ করে যাই, দেশ এগিয়ে যাক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। জনগণের ওপর আমাদের ভরসা আছে, জনগণ আমাদের পাশে আছে। জাতির পিতাই তো বলে গেছেন বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, তো কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
রবিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২’ এবং জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২ বিতরণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে বাধা দিয়েছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ^কে আমরা এই বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছি যে, বাংলাদেশ পারে, আমরাও পারি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রফতানি পণ্য বাড়াতে যার যার জলাধার রয়েছে তা মাছ চাষের আওতায় আনার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের মাছের কোন অভাব হবে না এবং নতুন রফতানি আইটেম যুক্ত করতেও সক্ষম হব। যদি যার যার জলাধার আছে, তারা যদি মাছ চাষের আওতায় আনার জন্য বিশেষ মনোযোগ দেয়।’
‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারাদেশে ২৩ জুলাই থেকে আগামী ২৯ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক মৎস্য খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে জাতীয় মৎস্য পদক-২০২২ প্রদান করেন। মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক পুরস্কার পর্বটি সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ ইয়ামিন চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য রাখেন। ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২’ উদযাপন উপলক্ষে গণভবন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে মৎস্য খাতে দেশের উন্নয়ন বিষয়ক একটি তথ্য চিত্রও প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন মাঠে তিন দিনব্যাপী কেন্দ্রীয় মৎস্য মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে নিরাপদ পুষ্টির চাহিদা মেটাতে মাছের গুরুত্বের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ এলাকার জলাধারে মাছ চাষের আহ্বান এবং মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। হাওর অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু হাওর না, বাঁওর, খাল, বিল, বিভিন্ন জলাধার এত জায়গা আমাদের।
আমার তো মনে হয় যার যেখানে এই ধরনের জলাধার আছে তারা যদি এই মৎস্য উৎপাদন করার দিকে একটু নজর দেন। শুধু মাছও না মাছের সঙ্গে কাঁকড়া, শামুক আছে, ঝিনুক আছে সব কিছুই করা যায়। কাজেই সেগুলো করতে পারলে আমাদের নিজেদের কোন অভাব থাকবে না। রফতানি ক্ষেত্রে আমরা নতুন নতুন পণ্য দিতে পারব।
সরকারপ্রধান এ সময় সারাদেশে ১শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে খাদ্য ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং তরুণ প্রজন্মকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এর ফলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
মাছের অভয়ারণ্য তৈরির দিকে নজর দেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মৎস্য খাতে গবেষণা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, তার সরকারের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ উদ্যোগের ফলে বিলুপ্ত প্রজাতির অনেক মাছকে আবার জলাশয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এবং মিষ্টি পানির মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের যে চাহিদা সে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি মাছ এখন উৎপাদন করতে পারি। তিনি বলেন, সবচেয়ে নিরাপদ পুষ্টি পাওয়া যায় মাছ থেকে। যেটা মাংস থেকে হয় না। মাছের যে আবাসস্থল অর্থাৎ অভয়ারণ্য তৈরি করা- এগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পানির প্রবাহটা ভাল থাকা, পানি যাতে দূষণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার এবং কুয়াকাটাসহ সমুদ্র এলাকায় চিংড়ি চাষে হ্যাচারি শিল্প গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, নেট দিয়ে চিংড়ির পোনা আহরণে অনেক প্রজাতির মাছ নষ্ট হয়। কাজেই সেগুলো বন্ধ করতে হবে এবং সেখানে হ্যাচারি শিল্প গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত চিংড়ি পোনা দেশব্যাপী সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়ারও প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং পরিবেশ যে কোন ধরনের উৎপাদন অনুকূল বলেও তার অভিমত ব্যক্ত করেন এবং সেটা সকলকে কাজে লাগানোরও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার পদ্মা সেতু করেছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছে। কাজেই দক্ষিণাঞ্চলে আরও বেশি মৎস্য চাষের উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সরকার জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে পুষ্টিটা আসবে মাছ, ডিম, দুধ ও মাংসের মাধ্যমে। শুধু আমরা নিজেরাই চাহিদা মেটাব না আমরা এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশেও পাঠাতে পারব। মাছের নানা বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করে সেটা শুধু প্রক্রিয়াজাত করে দিলে শুধু দেশের মানুষ না, প্রবাসীরাও নিজের দেশের মাছটা গ্রহণ করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এবং এই মাছে ভাতে বাঙালি হিসেবেই যেন আমরা থাকতে পারি। মাছ প্রক্রিয়াজাত করে মাছটা অক্ষত রেখে এর কাঁটা নরম করে ফেলে খাওয়ার উপযোগী করা যায় এবং এটা খুব বেশি কঠিন নয়, ঘরে ঘরেও এই পদক্ষেপ নেয়া যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রেসার কুকারে একটু বেশিক্ষণ মাছ সিদ্ধ করলেও এর কাঁটা নরম হয়ে যায় এবং বাচ্চাদেরও খাওয়ানো যায় বলেও উল্লেখ করেন। নিজের পরিবারেও প্রধানমন্ত্রী এ রকম করেন বলে একটু রান্নার রেসিপিও দিয়ে দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রি যদি তৈরি করি করি এবং প্রেসার দিয়ে মাছ অক্ষত রেখে এর কাঁটা নরম করে যদি একে টিনজাত করতে পারি, প্রক্রিয়াজাত করে দেশে-বিদেশে রফতানি করতে পারি- পৃথিবীর বহুদেশ এই মাছ কিন্তু নেবে। অথবা মাছের তৈরি বিভিন্ন পণ্য আমরা রফতানি করতে পারব। তাই আমি মনে করি এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ প্রজন্ম আরও এগিয়ে আসবে। এতে করে তাদের কর্মসংস্থান যেমন হবে এবং দেশের বেকারত্ব দূর হবে। আর সেই সঙ্গে দেশও রফতানিযোগ্য পণ্য পাবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও মিটবে। আর সেভাবেই দেশকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব বলে বিশ^াস করি।
এই মৎস প্রক্রিয়াজাতকরণে আরও বেশি সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমা থেকে আহরণৎযোগ্য ‘সি উড’ (সমুদ্রের তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ) একটি মূল্যবান সম্পদ। এটা আমরা যত বেশি উৎপাদন করতে পারব তত বেশি বিদেশেও রফতাননি করতে পারব এবং দেশেও এটার চাহিদা বাড়ছে। সেই সঙ্গে শামুক ও ঝিনুক চাষের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, এটাও একটি বড় রফতানি পণ্য হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কাজেই এদিকটাতেও একটু গুরুত্ব দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় আমাদের মেঘনা নদীতে পিংক পার্ল (মুক্তা) হতো। সেটাও গবেষণা আমরা করছি। কিন্তু সেটাতে খুব বেশি সাফল্য আসছে না। সে দিকটা আরেকটু নজর দেয়া দরকার। যদিও আমাদের খুব বড় সাইজের (মুক্তা) আসে না, আমাদের ঝিনুক অনেক ছোট। কিন্তু আমাদের রাইস পার্ল যেটা- এটাও কিন্তু অনেক মূল্য আছে। এটা আমাদের খুব ভাল একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কাজেই সেদিকেও একটু দৃষ্টি দেবেন।
মাছের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা বৃদ্ধিসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথাও অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মিষ্টি পানির মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। দেশীয় বা বিলুপ্ত প্রজাতির অনেক মাছ এখন গবেষণার মাধ্যমে ফিরে আসছে। যেটা আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছে, আবার ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। তিনি বলেন, মাছের যখন মৌসুম আসে; যেমন ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার সময় কেউ যাতে জাটকা না ধরে সে জন্য আমরা মৎস্য চাষীদের নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে থাকি এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছি। খাঁচার মধ্যে মাছ চাষের ব্যবস্থাও আমরা করে দিয়েছি। এ খাতে নতুন নতুন কমংস্থানের ব্যবস্থা আমরা করে যাচ্ছি।