দাবানলে পুড়ছে ফসল ও বনভূমি ॥ রেকর্ড তাপপ্রবাহে নাজেহাল পশ্চিম ইউরোপ

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্মরণকালের রেকর্ড তাপপ্রবাহে নাজেহাল পশ্চিম ইউরোপ। তাপপ্রবাহের কারণে সৃষ্ট দাবানলে মহাদেশটির বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল ও বনভূমি পুড়ে গেছে। শুক্রবারও ব্রিটেনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রীর ওপর। জার্মানি, বেলজিয়াম, গ্রীস, ইতালি, মরোক্কো, স্পেন, পর্তুগাল ও ক্রোয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ দাবানল নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। ১০ দিনের তাপপ্রবাহে শুধু স্পেনেই মারা গেছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ মানুষ।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ শুক্রবার বলেন, স্পেনে গত ১০ দিন ধরে রেকর্ড তাপপ্রবাহ চলছে এবং এর জেরে এই সময়ের মধ্যে দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচশ লোক মারা গেছেন। তাপপ্রবাহে প্রাণহানির বিষয়ে সোমবার কার্লোস তৃতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছেন প্রধানমন্ত্রী সানচেজ। স্প্যানিশ এই সংস্থার পরিসংখ্যানটি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে তাপজনিত মৃত্যুর হিসাব বের করে থাকে। স্প্যানিশ এই স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট জোর বলেছে, তাপপ্রবাহে প্রাণহানির বিষয়ে তাদের উল্লেখ করা সংখ্যাটি একটি পরিসংখ্যানগত অনুমান এবং এটি সরকারী মৃত্যুর রেকর্ড নয়।
প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ আরও বলেন, আমি নাগরিকদের চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে আহ্বান জানাচ্ছি। স্পেনসহ পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে।
গত সপ্তাহে কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। এর ফলে এসব অঞ্চলে বহু সংখ্যক দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনের আবহাওয়া সংস্থা এইএমইটি জানায়, ৯-১৮ জুলাই তাপপ্রবাহ ছিল স্পেনে রেকর্ড করা সবচেয়ে তীব্র। এইএমইটির মুখপাত্র বিট্রিজ হারভেলা বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালে আধুনিক রেকর্ড রাখা শুরু“হওয়ার পর থেকে ভৌগোলিক সম্প্রসারণ এবং সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহ।’ তিনি আরও বলেন, এ ধরনের আরও দুটি তাপপ্রবাহ এর আগেও দীর্ঘসময় ধরে স্থায়ী ছিল। এর একটি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ২৬ দিন স্থায়ী ছিল এবং অন্যটি ছিল ২০০৩ সালের আগস্টে। এটি স্থায়ী ছিল একটানা ১৬ দিন। জাতিসংঘ বলেছে, ইউরোপে চলমান দাবদাহ পরিস্থিতি আরও নিয়মিত এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এই প্রবণতা ২০৬০ সাল পর্যন্ত চলতে পারে। সম্প্রতি এসব কথা জানিয়ে দাবদাহ নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে জাতিসংঘ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বলেছে, বায়ুুমণ্ডলে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করে, এমন দেশগুলোর জন্য বর্তমান তাপপ্রবাহ একটি সতর্কসংকেত। ডব্লিউএমওর প্রধান পেত্তেরি তালাস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এটা (দাবদাহ) আরও বেশি স্বাভাবিক ও নিয়মিত হয়ে উঠবে এবং নেতিবাচক এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। অন্ততপক্ষে ২০৬০-এর দশক পর্যন্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা তাপমাত্রার একের পর এক রেকর্ড ভাঙছি। ভবিষ্যতে এমন দাবদাহ স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে। এমনকি এর চেয়ে আরও বেশি দাবদাহ দেখতে হতে পারে আমাদের। পেত্তেরি তালাস আরও বলেছেন, ‘কার্বন নিঃসরণ এখনও বাড়ছে। আমরা যদি কার্বন নিঃসরণকে একটা সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে না পারি, তাহলে ২০৬০-এর দশকে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে। বিশেষ করে এশিয়ার বড় দেশগুলোকে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। কারণ এসব দেশ বড় কার্বন নিঃসরণকারী। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে চলমান প্রচণ্ড দাবদাহ নিয়ে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলন করে ডব্লিউএমও। ডব্লিউএইচওর স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পরিচালক মারিয়া নেইরা বলেন, ইউরোপে ২০০৩ সালের দাবদাহে ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
মারিয়া নেইরা বলেন, ‘আমাদের শরীরে তাপমাত্রা ঠিক রাখার যে সক্ষমতা, এই তাপ শরীরের সেই সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এতে নানান রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ।’ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেকর্ড তাপমাত্রায় জনজীবন রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশেই দাবানলে পুড়ছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। উষ্ণতাজনিত কারণে মৃত্যুও বাড়ছে। তাপপ্রবাহের ফলে ব্রিটেনের আবহাওয়া দফতর ইয়র্ক ও ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বড় অংশজুড়ে একটি ‘লাল সতর্কতা’ জারি করেছে। যুক্তরাজ্যের বাকি অংশেও উচ্চ তাপমাত্রার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডের বাকি অংশ, পুরো ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের কিছু অংশে জারি হয়েছে হলুদ সতর্কতা। অবশ্য দেশটিতে চরম তাপপ্রবাহজনিত সতর্কতা ব্যবস্থাই চালু হয়েছে ২০২১ সালে। এর মধ্যে দিয়ে এ বার্তা তুলে ধরা হয় যে মানুষ ও অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক প্রভাব হতে পারে। তাই কাজ ও দৈনন্দিন রুটিনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। গরমের কারণে কিছু স্কুল আগেভাগে ছুটি অথবা স্কুল না খোলার পরিকল্পনা করছে।
যদিও স্কুল খোলা রাখতে সরকারীভাবে নির্দেশিকা জারি হয়েছে। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম গিরোন্ড অঞ্চলে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকে ২০ হাজারেরও বেশি লোককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে দাবানল আরও ঘন ঘন, আরও তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
শিল্পযুগ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর ইতোমধ্যেই প্রায় ১ দশমিক ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার কার্বন নির্গমন হ্রাসে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তাপমাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন বলেন, আগুনে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার হেক্টর বা প্রায় ৩০ হাজার একর জমি পুড়ে গেছে। তিনি দমকলকর্মীদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন। মঙ্গলবার থেকে পর্তুগালে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং স্পেনে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে পৌঁছায়। এতে গ্রামাঞ্চল দাবানলে জ্বলছে। পর্তুগালের আবহাওয়ার পূর্বাভাসদাতারা বলেন, আগামী সপ্তাহে কমার আগে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে থাকবে। পর্তুগালের আগুন বেশি জ্বলছে পোর্তো শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। দাবানলে এ বছর দেশটির ৩০ জাহার হেক্টর বা ৭৫ হাজার একর জমি ধ্বংস করেছে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে দাবদাহ অনেক বেশি নিয়মিত, তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।