দেশে ২১ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক গাড়ী চালাচ্ছে, ঘটছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পরিবহন মাফিয়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না পুলিশ ও বিআরটিএ। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে চালক দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এ ধরনের অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো আছেই, মানুষজন প্রাণ হারাচ্ছেন বেঘোরে। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের অবস্থার লাগাম ধরে টানা সম্ভবপর হচ্ছে না। সারাদেশে সব মিলিয়ে ২০ ধরনের ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি যানবাহন বা গাড়ি আছে।
এসব যানবাহনের বিপরীতে রয়েছে প্রায় ২১ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক। দেশে বর্তমানে ফিটনেস গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখ ৪০ হাজারের বেশি। পুলিশের নাকের ডগায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। গত এক বছরে ফিটনেস গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। দফায় দফায় কর মওকুফের পরও গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না মালিকরা। সড়কে দুর্ঘটনার মারাত্মক ঝুঁকি এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি। পুলিশের অভিযানেও কমছে না এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা। ফিটনেস গাড়ির সঙ্গে আছে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের চালকও। এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ, বেসরকারী সংস্থাসমূহ ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।
সারাদেশে সব মিলিয়ে ২০ ধরনের ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি সড়ক যানবাহনের বিপরীতে রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ ২৫ হাজার চালক। এর মধ্যে প্রায় ২১ লাখ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সই ভুয়া নয়তো নেই। সারাদেশে সব মিলিয়ে ২০ ধরনের ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি সড়কযানের বিপরীতে প্রায় ২১ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছেন। এসব সড়কযানের বিপরীতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ২৫ হাজার ৭০০। এরপর গত ৮ মাসে আরও দুই লাখ চালককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই সংখ্যা হবে ৩০ লাখ ২৫ হাজার। সেই হিসেবে দেশে এখন প্রায় ২১ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছেন বলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবি।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সূত্রে জানা গেছে, লাগামহীন দুর্ঘটনা, নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই নাজুক। ঈদযাত্রা ও ফিরতিযাত্রায় দুর্ঘটনা যেমন নিত্যসঙ্গী, তেমনি এ সময় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যাও বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পবিত্র ঈদকে সামনে রেখে ঘরমুখী মানুষের নিরাপদ যাতায়াতের প্রত্যাশায় কিছু সুপারিশ করা হয়, যা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে বর্তমানে ৫ লাখ ৪০ হাজারের বেশি। গত বছর এমন গাড়ি ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। প্রায় এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে ৫৯ হাজার ৪৮টি। ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের খুদে বার্তা বা এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস হালনাগাদের জন্য নিয়মিত তাগাদা দেয়া হচ্ছে। বিআরটিএ এর পক্ষ থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদন্ড কারাদন্ড, ডাম্পিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও মালিকদের একটি বড় অংশ বিষয়টি কর্ণপাত করছেন না।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব গাড়ির মালিকদের অর্থদন্ড করা হচ্ছে। ১০ বছর বা এর বেশি সময় ধরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির তথ্য বিআরটিএর ভান্ডার থেকে ধাপে ধাপে মুছে ফেলা হচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে তিন দফায় জরিমানা ছাড়াই কর দিয়ে ফিটনেস হালনাগাদের নির্দেশনা জারি করা হয়। এরপরও গাড়ির মালিকদের একটি অংশ নিয়মিতভাবে কর দিচ্ছেন না।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ অভিযান জোরদারের পাশাপাশি অন্য তদারকি কার্যক্রমও হাতে নিয়েছে।
পরীক্ষা ছাড়া কোন গাড়ির ফিটনেস সনদ নয় এমন নির্দেশনা থাকার পরও ফিটনেস সনদ পাচ্ছে যানবাহন এমন অভিযোগ আছে অন্তহীন। এ জন্য বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ের পরিদর্শন ও পরীক্ষা ছাড়া কোন গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে কি না, তা তদারকিতে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত যে আদেশপত্র জারি করা হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয় কোন মোটরযান সরেজমিনে পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিআরটিএর কোন সার্কেল অফিস থেকে যাতে ফিটনেস সনদ দেয়া না হয়। বিষয়টি তদারকির জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। বিআরটিএর কোন সার্কেল অফিস থেকে সরেজমিনে না দেখে এবং কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে কি না কমিটি তা মনিটরিং করবে। মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেয়ার প্রতিবেদন কমিটিকে নিয়মিতভাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করতে হবে। কিন্তু সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে তো বটেই, এমনকি বিআরটিএর আদেশ, নির্দেশ, অভিযান উপক্ষো করেই এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী, বিআরটিএ থেকে মোটরযানের ফিটনেস সনদ নেয়ার বিধান রয়েছে। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মোটরযানের ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি। এ অবস্থায় মোটরযান মালিকদের স্ব স্ব মোটরযানের ফিটনেস নবায়নের জন্য অনুরোধ করে বারবার আদেশ দিয়েছে বিআরটিএ। ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ফিটনেসবিহীন মোটরযান ধ্বংস বা চিরতরে ব্যবহারের অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছে বিআরটিএ। এসব মোটরযানের নিবন্ধন বাতিলের কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। এটি করা হচ্ছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী।
বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কোন গাড়ি সড়কে চলাচলের উপযোগী কি না, তা যাচাই করার জন্য গাড়ির ৩২টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সব বিষয় খালি চোখে ধরা পড়ে না। মিরপুর ছাড়া বাকি সব সার্কেল অফিসে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় চোখে দেখে। চোখে শুধু গাড়ির বডি, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিনের অবস্থা, হেডলাইট ও লুকিং গ্লাস এ ধরনের ছয়-সাতটি অবস্থা দেখে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা যান্ত্রিক উপায়ে করতে ১৯৯৪ সালে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ২০০৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট পাঁচটি সেমি অটোমেটিক (আধা-স্বয়ংক্রিয়) ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) বা যানবাহন পরীক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত শুধু বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে এ কেন্দ্র চালু হয়।
জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯৮ সাল থেকে অংশীজনদের নিয়ে সভা করে থাকে। এসব সভায় বারবার অনুপযোগী যানবাহন উচ্ছেদের সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালে রাজধানীতে ২০ বছরের অধিক পুরনো বাস-মিনিবাসের চলাচল নিষিদ্ধ করে অভিযানও শুরু হয়। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভিযান চালানো হলে বাসমালিকরা বিভিন্ন কৌশলে ধর্মঘট শুরু করে দেন। ফলে অভিযান স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির সভায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৩ সালের জুনে কমিটির সভায় তিন মাসের মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এসব কেবল ঘোষণাতেই আটকে আছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে বছরের পর বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছে মালিক সমিতি। গাড়ি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদ করা সম্ভব। শুধু বাস নয়, লেগুনাসহ বহু অননুমোদিত গাড়ির ফিটনেস নেই।
ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে বিআরটিএর অননুমোদিত গাড়ি রয়েছে কমপক্ষে ১০ লাখ। এর মধ্যে নছিমন, করিমন ও ভটভটির মতো যানবাহনও আছে। এগুলোর নিবন্ধন ও ফিটনেস নেই। দুর্ঘটনার সঙ্গে এসব বাহন জড়িত। কম গতিসম্পন্ন এসব বাহনের হিসাব বিআরটিএ সংরক্ষণ করছে না। এটি করলে ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যেত।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও ট্রাফিক আইন না মানাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। সারাদেশেই লাইসেন্সবিহীন চালক সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানায় নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান বলছে- সারাদেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। ভুল ওভারটেকিংয়ের কারণে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। গত তিন বছরের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অদক্ষতার পাশাপাশি চালকের গোঁয়ার্তুমি অন্যতম বড় কারণ। তাদের হতাহতের সংখ্যাও উদ্বেগজনক।
নিসচার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাদর হিসাব অনুযায়ী দেশে লাইসেন্সবিহীন ২৪ লাখ চালক গাড়ি চালাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ অদক্ষ চালক বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ ভারি যানবাহন চালাচ্ছে। হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিয়ে অনেকে ভারি গাড়ি চালাচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো হচ্ছে। অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স নেই। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। অসংখ্য চালকও নিহত হচ্ছে। নিসচার হিসাব অনুযায়ী, ২৪ লাখ লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক গাড়ি চালাচ্ছে। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। বেশির ভাগ চালক ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে রাস্তায় নেমেছে।