নতুন প্রজন্মের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ॥ দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে তৈরি হও

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে আগামীতে নেতৃত্বদানে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের সোনার ছেলে মেয়েরা, তোমরা তৈরি হও আগামীতে দেশকে নেতৃত্ব দিতে। সর্বক্ষেত্রেই তোমরা তোমাদের মেধার বিকাশ ঘটাবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে; যেন বাংলাদেশ আর পিছিয়ে না থাকে। বাংলাদেশ এগিয়ে যায় এবং উদ্ভাবনী শক্তিতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আরও উন্নত হয়।’
আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে বিকাশ ঘটছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গবেষণার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা, যারা আজকে এই যে মেধা অন্বেষণ আমরা করছি, তারা যে নব নব সৃষ্টি করার যে চিন্তা-চেতনা, এই চেতনাই আমাদের আগামীদিনের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কাজেই আমরা বিজ্ঞান শিক্ষা, তার ওপর গবেষণা, স্বাস্থ্যের ওপর গবেষণা, আমাদের বিভিন্ন প্রাণী সম্পদের ওপর গবেষণা, কৃষির ওপর গবেষণা, বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার ওপর আমি সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আসলে গবেষণাই তো পারে আমাদেরকে পথ দেখাতে।
রবিবার ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা-২০২২’ এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর সেগুনবাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ নীতিমালা ২০১২ প্রণয়নের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রতিযোগিতাটির নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা’।
দেশে সকল সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের তিনটি গ্রুপে (ষষ্ঠ-অষ্টম, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ) বিভাজন করে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠানে ভাষা-সাহিত্য, দৈনন্দিন বিজ্ঞান, গণিত ও কম্পিউটার, বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ ও মুক্তিযুদ্ধ (শুধুমাত্র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য)সহ মোট পাঁচটি বিষয়ে তিনটি গ্রুপে দেশের ১৫ জন মেধাবীকে বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ পুরস্কার দেয়া হয়।
এ বছর এপ্রিল-মে মাসে প্রতিষ্ঠান, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা মোট ১৩২ জন থেকে বিচারকদের মূল্যায়নে ১৫ জন এ বছরের সেরা মেধাবী নির্বাচন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যককে ২ লাখ টাকার চেক, ক্রেস্ট, মেডেল ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ কামাল হোসেন বক্তৃৃতা করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আবু বকর সিদ্দিক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে রাজশাহী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী মিফতাহুল জান্নাত এবং রাজবাড়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র জুলকারনাইন নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে এই প্রতিযোগিতার ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে এ দেশের কর্ণধার হবে। তারাইতো আমার মতো প্রধানমন্ত্রী হবে, মন্ত্রী হবে, শিক্ষক হবে, বড় বড় কর্মকর্তা হবে এবং প্রশাসন, সংবাদিকতাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশের উন্নতি করবে। কাজেই সেইভাবে তারা তৈরি হোক। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমাদের চলতে হবে এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের যে বিকাশ ঘটছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তিনি এ সময় কৃষি, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন খাতে গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, গবেষণাই পারে এক্ষেত্রে পথ দেখাতে। আর আগামীর বাংলাদেশকে আজকের মেধাবীরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এ সময় সরকার প্রধান বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদেরকেও এই মেধা অন্বেষণে যুক্ত করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, কেননা এদের মধ্যেও বিশেষ প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে, এরাও আমাদের সন্তান এবং আপনজন সেই বিবেচনায় এদেরকেও মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। কাজেই নতুন প্রজন্মকে আমি বলব, সকলকে নিয়ে চল। তবেই আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারব। পুরস্কার বিজয়ী সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের যে সুপ্ত মেধা সেটাই আমাদের ভবিষ্যত।
জাতির পিতার বক্তব্য-‘সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই’ এর উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থাৎ সেবার মানসিকতাটা সকলের মাঝে থাকতে হবে। আজকে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে যেখানে যে আছেন সকলেই মনে রাখবেন আমাদের দেশের যে সম্পদ সকল কিছুই জনগণের সম্পদ। রোদ, ঝড় বৃষ্টি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই তাদের এই অর্জন, কাজেই তাদেরও এর ওপর সমান অধিকার রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে বলেন, আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছি দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করতে। কাজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ দিল আমি তখন সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করি। যা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমাদের দেশেরই কোন কোন ব্যক্তির প্ররোচণাতেই এটা ঘটে। তবে আমরা নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখিয়েছি- হ্যাঁ বাংলাদেশও পারে, আমরাও পারি।
জাতির পিতার তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি, আমরা বিজয়ী জাতি। তিনি আজকের শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের সবসময় এটা মাথায় রাখতে হবে যে আমরা বিজয়ী জাতি এবং বিশ্বে সবসময় মাথা উঁচু করে চলব, সম্মানের সঙ্গে চলব। আর এই দেশ আমাদের, এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে।
তার সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা এবং বিদ্যুতসহ নানা নাগরিক সেবা তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব এবং সেটা আজকের যারা নতুন প্রজন্ম তারাই পারবে। তিনি এই মেধা অন্বেষণকে একটি চমৎকার ব্যবস্থা আখ্যায়িত করে বলেন, এর মাধ্যমে অনেক সুপ্ত প্রতিভা বের হয়ে আসবে যারা আগামীতে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই তার সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্ব দেয় এবং ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট এবং নভোথিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা বা নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি বিকাশের এই যুগে জন্ম নেয়ায় প্রকৃতগতভাবেই অনেক মেধাবী। তাদের যে সুপ্ত মেধা রয়েছে সেটাকেই আমাদের অন্বেষণ করতে হবে এবং সেটাকেই আগামীর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার যেন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তেমনি ছেলে-মেয়েদের আরও ভালভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগও সৃষ্টি করে দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০’ প্রণয়ন করলেও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তা বাতিল করে দেয় এবং ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের পর তার সরকার পুনরায় সেই নীতি প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কেননা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির না করে কাজ করলে কখনও সাফল্য পাওয়া যায় না। জাতির পিতার করে যাওয়া ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সরকারের ১৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি।
যার মধ্যে রয়েছে- কৃষি, ভেটেরিনারি এ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ডিজিটাল, ইসলামি-আরবি, টেক্সটাইল, মেরিটাইম, এভিয়েশন ও এরোস্পেস, বেসরকারী ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি উপজেলায় তার সরকারের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডে সিড মানি হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছি।
নতুন করে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ১২ বছরের নিচেও টিকা দিয়ে সুরক্ষিত করা যায় কি না সেই অনুমোদনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আবেদন জানিয়েছে সরকার।