স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী, উন্নয়নে নতুন যাত্রা শুরু

10
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বর্ণিল উৎসব। বাতাসে উড়ল রঙিন আবির। মাওয়ায় পদ্মার তীরে উন্মোচিত হলো ফলক। খরস্রোতা পদ্মায় সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে খুলে গেল দখিনা দুয়ার। দুই দশকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রমত্তা পদ্মার বুকে শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-কংক্রিটের অবকাঠামো নয়, নতুন স্বপ্নেরও উন্মোচন করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে দেশের মানুষকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের সমর্থন আর সাহসেই তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছেন। কবির ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার; দারুণ সূর্য হবো, লিখবো নতুন ইতিহাস।’
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়, জেদ। যে জেদের কারণে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি। মানুষের সমর্থন আর সাহসেই আমি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছি।’
শনিবার বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে এ ফলক উন্মোচন করে স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। দুই দশক আগে তিনিই দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলার মানুষের এ স্বপ্নের সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সকালে হেলিকপ্টারে করে মাওয়ায় পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়ায় সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা কোনদিন মাথা নোয়াব না। বাঙালীর ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’ প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের ‘গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক আখ্যায়িত করে বলেন, সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ পদ্মার বুকে জ¦লে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে তার কোন অভিযোগ নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা, এই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। আমি আশাবাদী, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তাদের হয়তো চিন্তা-চেতনায় দৈন্য রয়েছে। আত্মবিশ^াসের অভাব রয়েছে। কাজেই তাদের দেশপ্রেম জাগ্রত হবে এবং দেশের মানুষের প্রতি তারা আরও দায়িত্ববান হবেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণ বিষয়ক সূচনা বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম, উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান, প্রজেক্ট ম্যানেজার এ্যান্ড সুপারভিশন কনসালটেন্ট রবার্ট জন এভিসসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সঙ্গে অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে থিম সঙ্গ- ‘বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন দেশ, তুমি দিলে পদ্মা সেতু, পৃথিবী তাকিয়ে রয়, মাথা নোয়াবার নয়’ পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকেট, সুভ্যেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১শ’ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর একটি রেপ্লিকাও উপহার দেয়া হয়। নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফটোসেশনেও অংশগ্রহণ করেন সরকারপ্রধান।
যার হাতে ভিত্তি, দুই দশক পর তাকেই প্রথম যাত্রী হিসেবে পেল দক্ষিণ জনপদের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে তার গাড়ি সেতুর টোল প্লাজার দিকে এগিয়ে যায়। দুমিনিট পর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর টোল প্লাজায় পৌঁছায়। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে টোলের টাকা দেন প্রধানমন্ত্রী। বহরে থাকা বাকি গাড়িগুলোর টোলও তিনিই পরিশোধ করেছেন বলে জানান টোল প্লাজায় দায়িত্বরত কর্মী তানিয়া আফরিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার নিজের গাড়ি এবং বহরের সব গাড়ি মিলিয়ে মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিয়েছেন। টোল দিয়ে বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে পদ্মা সেতুর দিকে এগিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। সেতুতে ওঠার আগে বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। বাতাসে রঙিন আবির উড়িয়ে বর্ণিল পরিবেশে উদ্বোধন হয় বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর। ফলক উন্মোচনের পর মোনজাত পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ ওঠায় পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তখনকার যোগাযোগ সচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর সেতুতে ওঠে বেলা ১২টা ৭ মিনিটে। কিছুক্ষণ পর বহরের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সেতুতে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। সেখানে প্রায় ১৫ মিনিট সময় কাটান তিনি। বিমানবাহিনীর কয়েকটি হেলিকপ্টার সে সময় পতাকা উড়িয়ে প্রদর্শনীতে অংশ নেয় সেতুর ওপরের আকাশে। বিমান থেকে ছড়ানো লাল, সবুজ, নীলসহ নানা রঙের ধোঁয়া। সেতুতে দাঁড়িয়ে মিগ-২৯ জঙ্গি বিমানের একটি প্রদর্শনীও উপভোগ করেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং বাংলাদেশের অটিজম আন্দোলনের পথিকৃৎ সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এক পর্যায়ে নিজের মোবাইল বের করে মায়ের সঙ্গে সেলফি তোলেন তিনি। ছবি তোলা শেষে প্রধানমন্ত্রী তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজনের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে ভিডিও কলে যুক্ত হন। ভিডিও কলেই মোবাইল ঘুরিয়ে হাসিমুখে পুরো এলাকা দেখান তিনি। প্রধানমন্ত্রী যখন ভিডিও কলে কথা বলা শুরু করেন, তখন পুতুলকে দেখা যায় ক্যামেরা হাতে মায়ের ছবি তুলতে। এরপর পুতুলকেও ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী, একসঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। মাওয়া প্রান্তের আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে মূল সেতুতে উঠে যান। সেখানে সেতুর মাঝপথে গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুটা সময় কাটান তারা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর গাড়ি বহর নিয়ে সেতুটি অতিক্রমের সময় সেতুটির মাঝ বরাবর নেমে সেতু এবং প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেন। প্রধানমন্ত্রী এরপরে পদ্মা সেতু পার হয়ে এর জাজিরা প্রান্তে উপস্থিত হন এবং পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করেন ও মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধান, কূটনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের জনগণের আবেগ ও জেদের প্রতীক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়, জেদ। যে জেদের কারণে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি। মানুষের সমর্থন আর সাহসেই আমি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সেতু নির্মাণ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, যারা এ প্রকল্পের জন্য বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে দিয়েছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলাম ড. মসিউর রহমানকে, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া- যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়, তাদের পরিবারসহ যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন- সকল প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশী-বিদেশী পরামর্শ, ঠিকাদার, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমি জানি আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজকে আমরা এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পারের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে শুধু তাই নয়। এই সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা আর আমাদের প্রত্যয় এবং এই জেদ যে, এই সেতু আমরা তৈরি করবই। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে এই সেতুর নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনও হতোদ্যম হইনি, হতাশায় ভুগিনি, আত্মবিশ^াস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি।
জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’র পুনরুল্লেখ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না, আমরা বিজয়ী হয়েছি। তারুণ্যের কবি সুকান্তের ভাষায় তিনি বলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ¦লে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা কোনদিন মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনও মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গুণগত মানে কোন আপোস করা হয়নি। এই সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে। সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এ রকম আরও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এই সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে- এটা নিশ্চিত। কারণ এটা একটা আশ্চর্য সৃষ্টি।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এ বিশাল কর্মযজ্ঞ থেকে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা। ভবিষ্যতে নিজেরাই এ ধরনের জটিল সেতু বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হবো আমরা। তিনি বলেন, সেতু নির্মাণ যেমন কঠিন ছিল, তেমনি আঁকাবাঁকা, খরস্রোতা উন্মত্ত পদ্মা নদীকে শাসনে রাখাটাও একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জও সফলভাবে মোকাবেলা করে নদীর দুই পাড়কে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর উভয় দিকে রয়েছে উন্নত ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন সার্ভিস এরিয়া।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া, প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তাদের নামে মামলা এবং বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধির ওই সময়ের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার ২২ দিনের মধ্যে আমরা নক্সা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকও এগিয়ে আসে। কিন্তু দেশের কোন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির জন্য বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে যায়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। তিনি কোন একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। আইনগতভাবে এমডির পদে থাকতে পারেন ৬০ বছর পর্যন্ত কিন্তু তিনি ৭০ বছর বয়স হয়ে গেলেও এমডি পদে বহাল থাকেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ওই ব্যাংকের এ্যাডভাইজার এমিরেটাস পদে থাকার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তিনি ক্ষেপে যান। সরকারের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের বিরুদ্ধে, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেও হেরে যান। এরপর আমরা দেখলাম বিশ্বব্যাংক আমাদের অর্থ বন্ধ করে দিল দুর্নীতির অভিযোগ এনে। বিষয়টি নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকজন অর্থনীতিবিদসহ কয়েকজন।
এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক জ্ঞানীগুণী তাঁদেরও নানা রকমের মতামত। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সত্যিই বুঝি দুর্নীতি হয়েছে। যেখানে কোন টাকা পয়সাই ছাড় হয়নি। কানাডার আদালত যখন রায় যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা, এখানে কোন দুর্নীতি হয়নি- তখন তারা থেমে যান। যারা বলেছিলেন, পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব না, তাদের বিরুদ্ধে তাঁর ‘কোন অভিযোগ নেই’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আমার কোন অনুযোগ নাই। তাদের হয়তো চিন্তার দৈনতা আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্যতা আছে বলে আমি মনে করি। আজ থেকে আমি মনে করি, আজ থেকে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে যে বাংলাদেশ পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যা মূল সেতুকে জাতীয় সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেতুর ৪১টির মধ্যে ৩৭টি স্পনের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেতু নির্মাণ কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে পদ্মা নদীর উভয় পাড়ের তিন জেলা- মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৫৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা তাঁর সরকার নিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সহায়তা, ভিটা উন্নয়ন সহায়তা দেয়া হয়েছে। তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য প্রদান করা হয়েছে কর্মমুখী ও আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় বনায়ন কর্মসূচীর পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা বহুমুখী এই সেতুর উপরের ডেক দিয়ে যানবাহন এবং নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। আশা করা হচ্ছে, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই-তিন শতাংশের বেশি হারে অবদান রাখবে এবং এর ফলে দারিদ্র্য নিরসন হবে।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, এ সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগের একটা বড় লিংক। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যে এই সেতুর ভূমিকা অপরিসীম। তাছাড়া পদ্মার দুপাড়ে পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ঢাকায় মেট্রোরেল। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হবে। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেটিও ২০২৩ নাগাদ চালু হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আবেগজড়িত কণ্ঠে রক্তাক্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা তুলে ধরে বলেন, ’৭৫- মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হারিয়ে ৬ বছর রিফিউজি হিসেবে জীবন কাটিয়েছি। ’৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করলে একরকম জোর করে রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে আসি। তখন এই জনগণই আমাকে আপন করে নেয়। তাঁদের মাঝেই আমি ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা, ভাইদের ভালবাসা। আর তিনি যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন তখনও এই জনগণই এগিয়ে আসেন। তাঁকে সাহস ও শক্তি জোগান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না থাকলে পদ্মা সেতু নির্মাণে কমপক্ষে ‘বিশ বছর’ সময় লাগত এবং প্রকল্প ব্যয়’১৫ বিলিয়ন ডলার’ দাঁড়াত বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ার ইসলাম। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয় এবং দূরদর্শিতার কারণেই ‘সময়ের মধ্যে’ এবং খরচ না বাড়িয়ে দেশের বৃহত্তম এই যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বক্তব্যের শুরুতে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সবার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত এগারো বছর দৃঢ় প্রত্যয় ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নইলে এই সেতু নির্মাণে বিশ বছর সময় লাগত। খরচ হতো ১৫ বিলিয়ন ডলার। এটা এই সময়ের মধ্যে, নির্ধারিত এই খরচের মধ্যে এবং আমাদের মর্যাদা উন্নত রেখে আমাদের এই প্রজেক্টটা যে সম্পন্ন করতে পেরেছি তার প্রধান এবং একমাত্র কারিগর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ কাজে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আপনারা বাইরে থেকে তার দৃঢ়তা, সংকল্পের কথা শুনেছেন আর আমরা তা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি। সচিব খন্দকার আনোয়ার ইসলাম মনে করেন সেতুর মাধ্যমে সরকারপ্রধান পুরো জাতিকে ‘একতাবদ্ধ’ করেছেন। তিনি বলেন, আমরাও আশা করব প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও জাতি গঠনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিব ইনশাআল্লাহ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। পদ্মার বুকে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বাঁধল রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলকে। দেশের দীর্ঘতম এই সেতুতে গাড়ি ও রেল দুটোই চলবে। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ নবেম্বর। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে যা শেষ হলো সাত বছরে।