তিনদিন পর বিএম কন্টেনার ডিপো ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করলো সেনাবাহিনী ॥ তবে আগুন এখনও পুরোপুরি নেভেনি, খন্ডবিখন্ড আরও দুই লাশ উদ্ধার

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঘটনার তিনদিন পর মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণে ধ্বংস সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোকে ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। কিন্তু শনিবার রাতে যে আগুন লেগেছে তা মঙ্গলবার পর্যন্ত একেবারে সম্পূর্ণভাবে নেভানো সম্ভব হয়নি। ঝুঁকি এড়াতে দূর নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে আগুন নেভানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে, উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত ফায়ার ফাইটারদের পক্ষে উপপরিচালক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে আগুনে পোড়া এবং বিভিন্ন খন্ড খন্ড বিচ্ছিন্ন আরও দুটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। যদিও এ লাশের পরিচয় জানা যাবে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পর শনাক্তকরণের মাধ্যমে। এর ফলে এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৩। যদিও চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন পূর্বে বলেছিলেন মৃতের সংখ্যা ৪৯। সোমবার ওইসব প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কয়েকটি লাশ দু’বার গোনা হয়েছিল।
এদিকে, সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ে গত শনিবার রাতে বিএম কন্টেনার ডিপোতে আগুন এবং পরবর্তীতে বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে নাশকতা বলে সন্দেহ ব্যক্ত করা হচ্ছে। আগুন লাগার পর বিস্ফোরণ ঘটনাস্থলের পাঁচ কিলোমিটার এলাকাকে প্রকম্পিত করেছে। শুধু তাই নয়, সন্নিহিত এলাকার বসতিকে ক্ষতিসাধন করেছে। মসজিদসহ বিভিন্ন বাড়ি-ঘরের দরজা, জানালার কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে কন্টেনারের খন্ডবিখন্ড টুকরা অনতিদূরে গিয়ে পড়েছে, যা অতিমাত্রার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির যে দৃশ্য হয়, অনুরূপ হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দু’দফায় বলেছেন, ঘটনাটির সঙ্গে নাশকতা থাকতে পারে। তথ্যমন্ত্রীর পর অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও। এর পরে সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকায় ফিরে গিয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, বিএম ডিপোর অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে কিছু একটা রয়েছে। তিনি এটাকে নিছক দুর্ঘটনা মনে করছেন না। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেন- এ ঘটনা নিয়ে এখনও কোন মামলা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে সচেতন বিভিন্ন মহলের পক্ষে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ তিনদিনের মাথায় এসে গত সোমবার দাবি করেছে- এটি নাশকতা। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এ আগুন ও বিস্ফোরণ নিয়ে ডিপো কর্তৃপক্ষের নিজেদের যেসব গাফিলতি রয়েছে তা নিয়ে কোন স্বীকারোক্তি জানায়নি। তবে ঘটনায় নিহত সাধারণ মানুষ এবং ফায়ার ফাইটারদের জন্য বিভিন্ন অঙ্কের অর্থের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের পক্ষে এসব ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে এই বলে যে, ডিপো কর্তৃপক্ষ কিছু একটা লুকোতে চাইছে কিনা। নাকি এত বড় দুর্ঘটনায় তারা হতবিহ্বল হয়েছিল। এছাড়া এ ঘটনার পর পুলিশ বা ডিপো কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার পর্যন্ত থানায় কোন জিডি বা মামলা করেনি। নিহতদের নিয়ে অপমৃত্যুর মামলাও হয়নি।
কিছু একটা ঘটেছে- সন্দেহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর : সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোতে সংঘটিত অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা মনে করছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, ওই ডিপোতে কিছু একটা ঘটেছে। তা না হলে এতগুলো প্রাণ যায় না, এটা আমি বিশ^াস করি। সীতাকুন্ডের ঘটনায় নিহত ফায়ার ফাইটার মোঃ শাকিল তরফদারের জানাযায় অংশ নেয়ার পর ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, দুটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারও গাফিলতি ছিল কিনা কিংবা ঘটনাটি সাবোটাজ কিনা বা উদ্দেশ্যমূলক কিনা, কেউ করিয়েছে কিনাÑ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।
আগুন পরিকল্পিত হতে পারে-নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী : নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শনিবার সীতাকুন্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঢাকায় ফিরে গিয়ে মঙ্গলবার তার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সেখানে কোন বিস্ফোরক ছিল না। যেহেতু বিস্ফোরক নয়, এ কারণেই তারা ঘোষণা দেয়নি। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দীর্ঘদিন ধরে রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এ কেমিক্যাল পণ্যটি বিক্রিয়ার ফলে বিস্ফোরণ হয়েছে। ফলে প্রথমে যারা আগুন নেভাতে গিয়েছিল তারা আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে যাবার আগে তিনি যা চিন্তা করেছিলেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অন্য চিত্র দেখেছেন। তিনি বলেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডকে কেন বিস্ফোরক আইটেম বলা হচ্ছে। এটি অনুমোদিত রফতানি পণ্য। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ এ রাসায়নিক পণ্য রফতানি করছে। এ ডিপো কর্তৃপক্ষ আইএস পিএস কোড অনুসরণ করছে। যেসব কমপ্লায়েন্স ছিল সবই তারা মেনেছে। সেখানে অগ্নিনির্বাপণের যেসব ব্যবস্থা থাকা দরকার, এর সবই ছিল। আন্তর্জাতিক বিপজ্জনক পণ্য পরিবহনের যে নীতিমালা রয়েছে সেখানে তা মানা হয়েছে। তিনি এমনও দাবি করেন, বর্তমানে যেসব বেসরকারী কন্টেনার ডিপো রয়েছে তন্মধ্যে বিএম কন্টেনার ডিপোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে ভাল। তিনি আরও বলেছেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের যে কন্টেনারগুলো ছিল এর কিছু কন্টেনারে আগুন লেগেছে, বিস্ফোরিত হয়েছে। মাঝখানে কিছু কন্টেনারের কোন ক্ষতি হয়নি। কিছুদূর পরে আবার কিছু কন্টেনারে আগুন লেগেছে, এটা সন্দেহজনক। কিভাবে এটি ঘটল, আগুন অস্বাভাবিক হয়ে গেল, একস্তর বাদ দিয়ে আরেকস্তরে আগুন লাগল, এটি সন্দেহজনক।
তদন্তের পর আইনী কার্যক্রম শুরু হবে-আইজিপি : তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনী কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বিএম ডিপো পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
আইজিপি বলেন, ডিপোতে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনী কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বিএম কন্টেনার ডিপো কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : মঙ্গলবার বিএম কন্টেনার ডিপো কর্তৃপক্ষের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। ডিপোর মূল কাজ হলো দৈনিক ভিত্তিতে কন্টেনারের জন্য জায়গা ভাড়া দেয়া এবং তা আদায় করা। এখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি অফিস আছে। তারা ডিপোর আমদানি, রফতানি কাজে সর্বক্ষণিক তদারকি করেন। তাদের অনুমতি ব্যতীত কন্টেনার তো দূরের কথা, এককেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব। যে কোন কন্টেনারের লক-আনলক করতেও তাদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। ডিপোতে হাজার হাজার কন্টেনারের মধ্যে মাত্র একটি কন্টেনারে বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক। তাই, এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, একতরফাভাবে কেউ যদি এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য কেবল মালিক কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে, নানা অজুহাত খোঁজে সেটি দুঃখজনক এবং সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের জন্য বড় অশনি সঙ্কেত। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানিযোগ্য পণ্য। দেশের ছয়টি কোম্পানি এটি উৎপাদন করে। স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য পণ্যের মতো এটিও ডিপোতে শুল্কায়ন শেষে বন্দরের মাধ্যমে রফতানি হয়ে থাকে।