সিয়াম সাধনার মাস

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ মাহে রমজানের ২২তম দিবস। ধীরে ধীরে নগরীতে নেমে আসছে আপনজনদের কাছে ফেরার নানা স্বপ্ন পরিকল্পনা। তাই আজ আমরা এখানে সফরে বা ভ্রমণে থাকাকালীন সময়ে নামাজ, রোজা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ইবাদত সংক্রান্ত বিধি-বিধান নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। কোরানুল করীমে ইরশাদ হয়েছে ঃ ‘যখন তোমরা কোন দেশ সফর কর, তখন নামাজে কিছুটা হ্রাস করলে তোমাদের কোন গুনাহ নেই, যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, কাফেররা তোমাদের উত্ত্যক্ত করবে। নিশ্চয় কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’- (সুরা নিসা -১০১)
পবিত্র কোরানের উপরোক্ত আয়াতের মর্ম অনুযায়ী এবার আমরা দেখব যে, এখানে দেশ ভ্রমণ বা সফর বলতে কি বোঝানো হয়েছে এবং মুসাফির কারা? ইসলামী আইন বিশারদগণ এ ব্যাপারে বলেন যে, ন্যূনতম এক মঞ্জিল অথবা দুই মঞ্জিলের সফর যদি কেউ করে তবে তাতে শরীয়তের কোন হুকুম পরিবর্তন হয় না এবং শরীয়ত অনুযায়ী তাকে মুসাফির বলা যায় না। সমস্ত হুকুম তার জন্য অবিকল ঐরূপই থাকবে যেরূপ বাড়িতে থাকে। চার রাকাতের নামাজ চার রাকাতই পড়বে (রোজা ভাংতে পারবে না) এবং চামড়ার গেঞ্জির ওপর একদিন একরাত অপেক্ষা অধিককাল মসেহ করতে পারবে না। যে ব্যক্তি (কমপক্ষে) তিন মঞ্জিল দূরবর্তী স্থানে যাবার নিয়ত করে বাড়ি হতে বের হবে, তাকে শরীয়ত অনুযায়ী ‘মুসাফির’ বলা হবে। যখন সে নিজ শহরের লোকালয় অতিক্রম করবে, তখন তার ওপর মুসাফিরের হুকুম বর্তাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত লোকালয়ের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ সে মুসাফির হবে না (আর যদি লোকালয়ের বাইরে হয়, তবে স্টেশনে পৌঁছলে সে মুসাফির হবে)।
এখন প্রশ্ন হলোঃ তিন মঞ্জিল কি? (কাফেলা বেঁধে চললে খাওয়া-দাওয়া, পাক-সাফ এবং আরাম-বিশ্রামের সময় বাদ দিয়ে) স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বা নৌকায় চড়ে কিংবা উটের পিঠে সাওয়ার হয়ে তিনদিনে যতদূর পৌঁছা যায়, তাকে তিন মঞ্জিল বলে। আরব দেশে প্রায়ই মঞ্জিল নির্ধারিত থাকে। আমাদের দেশের মোটামুটি হিসেবে এর আনুমানিক দূরত্ব (প্রচলিত মাইলে) ৪৮ মাইল।
উল্লেখ্য, যদি কোন স্থান এতো পরিমাণ দূরবর্তী হয় যে, স্বাভাবিকভাবে পায়ে হেঁটে, নৌকাযোগে বা উটযোগে গেলে তিনদিন লাগে কিন্তু কোন দ্রুতগামী যানবাহন যেমনঃ মোটর, রেলগাড়ী, উড়োজাহাজ ইত্যাদি সে তুলনায় কম সময় লাগে এরূপ অবস্থায়ও মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। একই ভাবে যদি কমপক্ষে তিন মঞ্জিল যাবার নিয়ত না করে আর সমস্ত দুনিয়াই ঘুরে আসে, তবুও সে মুসাফির হবে না।
যে ব্যক্তি মুসাফির সে জোহর, আছর ও ইশা’র ফরজ নামাজ দুই দুই রাকাত পড়বে এবং সুন্নতের হুকুম এই যে, যদি ব্যস্ততা থাকে তাহলে ফজরের সুন্নত ব্যতীত অন্যান্য সুন্নত ছেড়ে দেয়া দুরস্ত আছে, এতে কোন গুনাহ হবে না আর যদি ব্যস্ততা না থাকে এবং সঙ্গীদের থেকে পেছনে পড়ে থাকার ভয় না থাকে তবে ছাড়বে না। সফর অবস্থায় সুন্নত পুরোপুরি পড়বে, সুন্নতের কসর হয় না। ফজর, মাগরিব এবং বিতরের নামাজে কসর নেই। বরাবরের ন্যায় পড়তে হবে। সফরকালীন সময়ে পূর্ণ নামাজের স্থলে অর্ধেক পড়ার মধ্যে কারো মনে এরূপ ধারণা আনাগোনা করে যে, বোধহয় এতে নামাজ পূর্ণ হলো না। এটা ঠিক নয়। কারণ কসর করাও শরীয়তের নির্দেশ। এ নির্দেশ পালনে গুনাহ হয় না বরং সওয়াব পাওয়া যায়।-(মা’ আরিকুল কোরান- ২৭৯)।
যদি কারো মুসাফিরী হালতে নামাজ ক্বাজা হয় এবং সেই নামাজ মুকীমী হালতে ক্বাজা পড়তে হয় তবে জোহর, আছর ও ইশা’র ফরজ দুই রাকাতই ক্বাজা পড়বে। এরূপ মুকীমী হালতে যদি নামাজ মুসাফিরী হালতে ক্বাজা পড়তে চায় তবে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজের ক্বাজা চার রাকাতেই পড়তে হবে।
রোজার হুকুম জারি করতে গিয়ে সুরা বাকারার ১৮৪ নং আয়াতে প্রসঙ্গক্রমে এসেছেঃ যদি তোমাদের কেউ (রমজান মাসে) হয়ে থাকে রোগগ্রস্ত অথবা মুসাফির তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এই সংখ্যা পূর্ণ করে। এ আয়াতের আলোকে কোরান ব্যাখ্যাকারী ও মুসলিম আইনবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সফররত অবস্থায় রোজা না রাখা ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সাহাবাগণ হযরতের (স.) সঙ্গে সফরে যেতেন। তাদের কেউ রোজা রাখতেন আবার কেউ রাখতেন না। উভয় দলের কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলতেন না। হযরত নিজেও কখনও কখনও সফরে’ রোজা রেখেছেন, কখনও রাখেননি। এক সফরে এক ব্যক্তি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। তার চারদিকে লোক জড়ো হলো। এ অবস্থা দেখে হুজুর (স.) ব্যাপারটি জানতে চাইলেন। বলা হলো, ‘এই ব্যক্তি রোজা রেখেছে’।
জবাব দিলেন-‘এটা সৎ কাজ নয়।’ শরীয়তের বিধান হলো, সফরে যদি কোন কষ্ট না হয়, যেমন- কেউ গাড়িতে ভ্রমণ করছে। ধারণা এই যে, সন্ধ্যানাগাদ বাড়ি পৌঁছে যাবে কিংবা সঙ্গে ভাল খাবার দাবার আছে। তবে রোজা রাখাই উত্তম, কিন্তু না রাখলে গুনাহ হবে না; অবশ্য, রমজানের ফজিলত হতে মাহরুম হবে। যদি রোজা রাখতে কষ্ট হয়, তবে রোজা না রাখাই ভাল। কিন্তু প্রথমে রোজার নিয়ত করে তা আবার ভঙ্গ করা সমীচীন নয়।
পানির অভাবজনিত পরিস্থিতিতে তায়াম্মুমের বিধান দেয়া হয়েছে কোরান শরীফে বলা হয়েছেÑ আর যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে থাক কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি পেশাব-পায়খানা থেকে এসে থাকে কিংবা নারী-গমন করে থাকে কিংবা পরে যদি পানিপ্রাপ্তি সম্ভব না হয়, তবে পাক পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও। -তাতে মুখম-ল ও হাতকে ঘষে নাও। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল।-(সূরা নিসা-৪৩)
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অপার রহমত ও করুণা যে, তিনি অজু, গোসল প্রভৃতি পবিত্রতার নিমিত্ত এমন এক বস্তুকে পানির স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছেন, যার প্রাপ্তি পানি অপেক্ষাও সহজ। বলা বাহুল্য, ভূমি ও মাটি সর্বত্র বিদ্যমান। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, এ সহজ ব্যবস্থাটি একমাত্র উম্মতে মুহাম্মদিকেই দান করা হয়েছে।-(মা’অরিফ-২৫৩)।