বিবিয়ানা গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হচ্ছে আজ

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিবিয়ানা গ্যাসকেন্দ্রের বন্ধ হওয়া ৬টি কূপের মধ্যে একে একে ৫টি কূপই উৎপাদন শুরু করেছে। ৫ নাম্বার কূপটি উৎপাদনে আসায় আরও ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। এছাড়াও গত বৃহস্পতিবার সকালে মহেশখালীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেটের টার্মিনালে এসে পৌঁছেছে একটি এলএনজি কার্গো। শুক্রবার সকালে সামিটের টার্মিনালে এসেছে আরও একটি। ফলে বিবিয়ানা থেকে এখন জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে ১১৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ফলে বিবিয়ানাসহ দেশের অন্যান্য কূপ থেকে এখন জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে মোট ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর আমদানি করা এলএনজি থেকে যোগ হচ্ছে আরও সাড়ে ৮শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ফলে মোট চাহিদা ৩২০০-৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ৩১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসই জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। আজকের মধ্যেই বিবিয়ানার ৬ নম্বর কূপও উৎপাদনে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে চলমান গ্যাসের সঙ্কট আজ থেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত রবিবার রাতে দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদনশীল গ্যাসকেন্দ্র বিবিয়ানার একটি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসের সঙ্গে বালু উঠতে শুরু করে। এ কারণে বন্ধ করে দিতে হয় একে একে ৬টি কূপের উৎপাদন। এতে রবিবার রাত থেকে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেয়। এরপর সোমবার একটি এবং মঙ্গলবার আরও তিনটি কূপ উৎপাদনে আসে। বৃহস্পতিবার আরও একটি কূপ উৎপাদনে আসে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবং আর কোন বিপত্তি না থাকলে আজ শনিবার থেকেই আবাসিক এবং গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানান পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, বিবিয়ানাতে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি সৃষ্টি হলেও এলএনজি দিয়ে সেই ঘাটতি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানির অস্থিতিশীল থাকায় আমাদের হাতে সেই পরিমাণ সরবরাহ ছিল না। তবে রবিবার রাতেই আমাদের টেকনিক্যাল টিম কূপ মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়। সোমবার পেট্রোবাংলা থেকে একটি মনিটরিং টিমও ফিল্ড এলাকায় যায়। ওইদিন রাতেই তিনটি কূপ থেকে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। মঙ্গলবার ৪ নাম্বার কূপও উৎপাদনে আসে। বৃহস্পতিবার ৫ নাম্বার কূপটিও উৎপাদনে চলে আসে। ৬ নাম্বার কূপটাও আগামীকাল (আজ) রাতের মধ্যে উৎপাদনে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এখান থেকে আপাতত ৭০ মিলিয়নের জায়গায় ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হবে কিন্তু আমদানিকৃত এলএনজির কারণে জাতীয় গ্রিডের গ্যাসের চাহিদা পুরোপুরি পূর্ণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
একই কথা জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এই সঙ্কটকালে গ্রাহকরা ধৈর্য ধরায় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই বিবিয়ানায়ার উৎপাদন ১১শ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়। এখন সব কূপ মিলিয়ে ১১৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এই ফিল্ডে সমস্যা দেয়া দেয়ায় জরুরী মেরামতের জন্য কোন কোন এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ সৃষ্টি হয়েছিল গত কয়েক দিন। আমাদের প্রকৌশলীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে আমরা এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তবে যেহেতু কূপগুলো একে একে উৎপাদনে আসছে আর এলএনজি কার্গোও এসে ভিড়েছে বন্দরে তাই সবকিছু ঠিক থাকলে শনিবার থেকেই সঙ্কট পুরোপুরি কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি।
চলমান গ্যাসের এই সঙ্কট আবাসিকের পাশাপাশি শিল্প কারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাস নিতে গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। জানা গেছে, রাজধানীর আশপাশে যেমন সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরের ছোট ছোট কারখানাগুলোতে গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রায় বন্ধ ছিল। যেসব কারখানায় বিদেশী ক্রয়াদেশ ডেলিভারি দিতেই হবে সেগুলো বিকল্প উপায়ে উৎপাদনের কাজ চালিয়ে গেছে।
এদিকে গ্যাস সঙ্কটের মধ্যেই চলতি বছরের সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বৃহস্পতিবার রাতে পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ১ মেগাওয়াট। আমরা উৎপাদনও করেছি ১৪ হাজার ১ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত উৎপাদন হওয়ায় কোথাও লোডশেডিং না ছিল বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, এর আগে গতবছরের ২৭ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশে রেকর্ড ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের ২২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে।
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম পবিত্র মাস হিসেবে পরিচিত রমজানের সেহেরি ও ইফতারের সময় গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এবছরও রমজানের শুরুতেই গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তবে এ সময়টা গ্যাস-বিদ্যুত ব্যবহারে স্যাশ্রয়ী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, রমজান মাসে গ্রাহকদের বিদ্যুত ও গ্যাসের ব্যবহারে সংযম ও মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। গ্রীষ্ম এবং সেচ মৌসুম চলছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি। আর বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন গ্যাসের। শতভাগ বিদ্যুত নিশ্চিত করার পর সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিদ্যুত বিভাগ সর্বাত্মক কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সবার স্বার্থে বিদ্যুত ব্যবহারে সংযম ও মিতব্যয়ী হতে হবে।
এর আগে রমজান মাস ও গ্রীষ্ম মৌসুমে গ্যাস ও বিদ্যুত সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রতিবারের মতো কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে, বিদ্যুত উৎপাদনকারী কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত বা বৃদ্ধি করা, পিক আওয়ারে (সান্ধ্যাকালীন) চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুত উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ইফতার-তারাবির নামাজ ও সেহেরি সময়ে লোডশেডিং না করা, টেকনিক্যাল কারণে বা অন্য কোন কারণে যেন লোডশেডিং না হয় সেদিকে সজাগ থাকা, সব বিতরণ সংস্থা বা কোম্পানিকে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পরীক্ষা করে প্রতিস্থাপন করা এবং স্টোরে পর্যাপ্ত ট্রান্সফরমার মজুদ রাখা, অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম জোরদার করা, বিদ্যুত সাশ্রয়ের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টমিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিদ্যুতের অপচয় রোধে সিএফএল বাল্বের পরিবর্তে এলইডি বাল্ব প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সুপার মার্কেট, পেট্রোল পাম্প ও সিএনজি গ্যাস স্টেশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাতি ব্যবহার না করা, রমজান মাসে দোকানপাট, মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলো খোলা রাখার বিষয়ে বিদ্যমান বিধিবিধান অনুসরণ করা, ইফতার ও তারাবির সময় শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এসি ব্যবহার সীমিত রাখা, সব দোকান মালিকদের মার্কেটের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক ইকুইপমেন্টগুলো পরীক্ষা করা, বিএসটিআইর প্রমাণ অনুযায়ী তার বা ইকুইপমেন্ট বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কিন্তু মাঝখানে বিবিয়ানার আকস্মিক এ দুর্ঘটনায় সব হিসাব উলট-পালট হয়ে যায়। গ্যাস সঙ্কটে রাজধানীসহ দেশের সব এলাকার মানুষকে পোহাতে হয় দুর্ভোগ। চুলায় গ্যাসের চাপ না থাকায় মুসল্লিদের সেহরি ও ইফতার তৈরিতে পোহাতে হয় দুর্ভোগ। গ্যাসের সঙ্কটে কারখানাগুলোতেও ব্যাহত হয় উৎপাদন। তবে আজ থেকে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।