বিভাগভিত্তিক সংসদ নির্বাচন করা ও ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়ার প্রস্তাব

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ এক দিনে না করে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভাগভিত্তিক করার সুপারিশ করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। এছাড়া সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার প্রস্তাবও করেছেন তারা।
বুধবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত তৃতীয় দফার এ সংলাপে অংশ নিয়ে সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা এমন প্রস্তাব ও সুপারিশ তুলে ধরেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপে অংশ নিয়ে ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনে না করার প্রস্তাব করেন।
তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘একেক জেলায় একেক দিন ভোটগ্রহণ হলে নির্বাচনের পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। বিভাগভিত্তিক জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। দেখা যাবে আওয়ামী লীগ কটি সিট পায়, আর বিএনপি কটি সিট পায়।
‘৩০ শতাংশ ভোটার যদি ভোট দিতে যায় তাহলে একজন এত ভোট পায় কী করে? এগুলো অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। গত নির্বাচনে কে কত ভোট পেয়েছে তা নিয়ে রিসার্চ করা যায়। কেন বিএনপি আসবে না?’
ইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আশা করি না আপনারা শতভাগ ন্যায্য ভোট করবেন। ৫০ শতাংশ সাফল্য পেলে স্যালুট জানাব। আগামী নির্বাচন ভালোভাবে না হলে খুনোখুনি হবে। মেশিনগান নিয়ে নামবে।’
‘আপানারা ভালো একটা কাজ করতে এসেছেন। ডু অর ডাই এটিচুড না থাকলে আমরা বাঁচব না। সবাই বলে আগে টাকা করব, তারপর রাষ্ট্রক্ষমতায় যাব। লোকাল ইলেকশন থেকে সব জায়গায় একই হচ্ছে। সিস্টেম হ্যাজ বিন ব্রোকেন, মোরাল হ্যাজ বিন ব্রোকেন।’
সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, ‘নির্বাচনি এলাকার সীমানা পরিবর্তন হয় হঠাৎ করে। আমাদের এলাকায় তিনবার হয়েছে।’
এই সম্পাদক বলেন, ‘ডিসি-এসপিকে বললে এখন আর কোনো কাজ হয় না। আমরা যাচ্ছি কোথায়? লিডারশিপের অভাব প্রতিটি বেলায়। আমরা এখন ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রথমে গণভবন, তারপর আল্লাহর দিকে।’
তাসমিমা হোসেনের বক্তব্য সমর্থন করেন প্রথম আলো পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন। ইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে এক দিনে নির্বাচন না করে ভাগ ভাগ করে নির্বাচন করতে পারেন।’
তিনি বলেন, ইসির কাছে ১২ কোটি ভোটারের দায়িত্ব। তাদের সাফল্য ব্যর্থতা আগামী নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে। তাই বাধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। শতভাগ ভোটদানের নিশ্চিয়তা ইসিকে দিতে হবে। আগের ইসির কী ভুল ছিল, আর তার আগের ইসি কী ভাল কাজ করেছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া সারাদেশে একদিনে নির্বাচন না করে ভাগ করে যায় কি-না, ভারতে যেমনটা হয়, একমাস পরে ফলাফল প্রকাশ হয়। বাংলাদেশে এখনো চিন্তা করা যায় না যে একমাস পর ফল প্রকাশ হবে।
তিনি বলেন, দলগুলো হেরে গেলে মেনে নিতে চায় না। যদি গণতন্ত্র চাই, নির্বাচনে হারতে হবে। যারা নিজেদের অবস্থান জানে, তারা আগে থেকেই ভাবতে থাকে কিভাব এই হারটা ঠেকানো যায়।
তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসক কেন রিটার্নিং কর্মকর্তা হবে। ইসির নিজস্ব লোকবল হতে হবে। লোকবল না থাকলে আগামী দুই বছরে সেই লোকবল আনতে হবে। প্রশাসনের কোনো লোক নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে না। কয়েকভাগে ভাগ করে নির্বাচন করলে ইসির লোকবল দিয়েই নির্বাচন করা সম্ভব।
সোহরাব হোসেন বলেন, সরকারের বা কোনো পক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার, তা নিতে হবে। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারাই যখন অংশীদার এবং নির্বাচনকালী সরকারের দায়িত্ব থাকেন, তখন যে স্বর্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, সেই দ্বন্দ্ব কিভাবে মেটানো যাবে সে বিষয়ে ইসির চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
৩০০ আসন নিয়ে ইসির গবেষণা থাকা উচিত। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা টিএন সেশন (ভারতের সর্বজনবিদিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার) চাই, নূরুল হুদা চাই না।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান বলেন, কী ধরনের সংকট আসতে পারে, তা কিন্তু আপনারা নিজেরাও মনে মনে জানেন। তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক, সব দল অংশ নিলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সুযোগ থাকে। গত নির্বাচনে সব দল অংশ নিল। আমরা দেখলাম বেলা ১২টা পর্যন্ত ভালো নির্বাচন হলো। তাই দলগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। দলগুলোর ফান্ড কীভাবে আসে। এমন নানা প্রশ্ন আসে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কমিশনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। দলগুলোকে কীভাবে আস্থায় আনা যায় সে কৌশল আপনাদের নিতে হবে। এছাড়া গণমাধ্যমের সঙ্গে কম কথা বলবেন। যত কম কথা বলবেন, তত ভুল কম হবে।
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরূল কবীর বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল ৭০ নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তান মানেনি বলে। আজ স্বাধীনতার পর ৫০ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের অবমামনা করা হবে; বিচারপতি সাত্তার কমিশনের অধীনে যেমন নির্বাচন হয়েছিল, তেমন নির্বাচন যদি করতে না পারি তাহলে সেটা আমাদের, রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচন কমিশন, সবার জন্য লজ্জার।
তিনি বলেন, আপনারা ব্যক্তিগত জীবনে যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন, এই পদগুলো বোনাস। তাই জীবনে আর হারানোর কিছু নাই। মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ আছে।
নির্বাহী বিভাগ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করবে বলে সংবিধানে বলা আছে। তাই আপনারা যদি চান নির্বাহী বিভাগকে শুনাতে বাধ্য করতে পারেন। সেটা করবেন কি-না, সেটা আপানাদের সিদ্ধান্ত। যে বাছাই কমিটির মধ্য দিয়ে কমিশনের নিয়োগ হয়েছে, সেই কমিটির প্রতি মানুষের আস্থা নেই। কাজেই আপনাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি শূন্যের কোটায় চলে গিয়েছিল। বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। যেকোনো একটি নির্বাচন তাদের জন্য এসিড টেস্ট হবে। তারা প্রথমেই কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এটাকে আমরা ব্যর্থতা হিসেবে দেখছি।
তিনি বলেন, কমিশনের মধ্যে বিভক্তি, এরকম যেন না হয়। যেন একক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। আরেকটি বিষয় সবগুলো দলকে নির্বাচনে আনা। এটি কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু গত কমিশনের সে চেষ্টাও ছিল না।
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়েছেন, এটা লজ্জার বিষয়। কাজেই নির্বাচন কমিশনের এখানেও একটি রুল আছে।
তিনি আরো বলেন, কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, এটা ইসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক ইসির দায়িত্ব হবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন উপহার দেওয়া। তবে যেখানে রাজনৈতিক সমঝোতা নেই, আস্থা নেই, সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা খুবই কঠিন কাজ।
দ্য অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সংবিধানের আওতায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাই জানেন তাদের দায়িত্ব কী। তাই দায়িত্ব পালনে কোথায় কোথায় বাধা আসতে পারে তা আপনারা জানেন। ব্যক্তিগত জীবনে সফলতা আসে, যদি সময়মতো সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) ক্ষমতা দেওয়া আছে, সংবিধানে আছে, সেটা প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি নির্বাচন হবে। এমনকি বাই নির্বাচনও হতে পারে। সেই নির্বাচন হচ্ছে লিটমাস টেস্ট। ভালো করতে পারলে যাদের এখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা রয়েছে, সেগুলো থাকবে বলে মনে হয় না। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে রাজনৈতিক অচলায়নতন দূর হবে।
দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে ইসির তৃতীয় দফা সংলাপে ২৩ সম্পাদকসহ ৩৪ জন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে সংলাপে অংশ নেন ২৩ জন। বাকি ১১ জন ইসির এই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি।
যারা সাড়া দেননি তারা হলেন- ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, জাগরণ সম্পাদক আবেদ খান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, আমাদের নতুন সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, কালের কণ্ঠ সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, আমাদের সময়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক কামরুল ইসলাম খান, সংবাদ সম্পাদক আলতামাশ কবির এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।