ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় জালনোট সিন্ডিকেট

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঈদ উৎসবের আগে বাড়তি কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে জালিয়াত চক্রের হোতারা ভেজাল নোটে আসল টাকার রূপ দিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের প্রধান টার্গেট বৃদ্ধ দোকানি। দ্বীপাঞ্চল, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবং শহরে যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কম সেখানে চলছে জাল নোট তৈরি। একাধিক হাত ঘুরে যুবক এবং নারীদের মাধ্যমেই বাজারে ছড়ানো হচ্ছে জালনোট। চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্প্রতি দু’টি অভিযানে ৫জনকে গ্রেফতার করলেও এর বাইরে যে চক্রের সদস্যরা অহরহ জালনোট বাজারে ছড়িয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দৌরাত্ম্য হ্রাসে জালনোট প্রতিরোধে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিডিওচিত্র প্রচার করতে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংকিং লেনদেন চলাকালীন সময়জুড়ে শাখাগুলোর টিভি মনিটরেও জালনোট এবং আসল নোট চেনার ভিডিও প্রদর্শনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দেশে প্রতিটি জেলায় সক্রিয় জালনোট কারবারিরা। ঈদের সময় এই ক্ষতিটা বেশ বড় অঙ্কের হয়। পান-সিগারেট, ফুটপাথের পোশাকের দোকানি, পাড়ার অলিগলির বয়স্ক দোকানিদের পাশাপাশি মাছ বিক্রেতা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি টার্গেট চক্রের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াত চক্রের কারিগররা আসল টাকার মতো নকল টাকায় নিরাপত্তা সুতা ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকে। এছাড়া জাল টাকার কারবারিদের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। যাদের নোট আসল টাকার ন্যায় হয় তাদের চাহিদা এবং দর বেশি। প্রতি লাখ বান্ডেলের দর ১৫ থেকে ৩০ হাজারে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারবারিরা নেমে পড়ে এই বান্ডেল নিয়ে।
সূত্রে জানা গেছে, পুরো বান্ডেল চালাতে তারা ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি নারীদের। আগে তিন ধাপে জালনোট কারবারিদের তৎপরতা দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে তারা কৌশল বদলে ‘ম্যান টু ম্যান’ পদ্ধতিতে টাকা ছড়াচ্ছে। যার ফলে একটি নোট নিয়ে কেউ ধরা পড়লেও মানুষের কাছে নিজেই ভুক্তভোগী বেশে কেটে পড়ছে।
চট্টগ্রামের বাকলিয়া, হালিশহর, ইপিজেড, নিউমার্কেট, কোতোয়ালির পাথরঘাটা, পূর্ব-পশ্চিম মাদারবাড়ি, তিন পার্বত্য জেলা ও পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন জালনোট ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র। ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের কাছে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অভিযোগ না করায় জালনোটের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আসল টাকার বান্ডিলে জাল টাকা : নগরীর ৪টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাছ ব্যবসায়ী, ফুটপাথের হকার ও খাতুনগঞ্জের পাইকারি বিক্রেতাদের পাঠানো টাকার বান্ডেলে অহরহ মিলে জালনোট। টাকা আদায়ের পরিমাণ বেশি থাকায় মাছ বিক্রেতারা তাদের পাওনাদার থেকে বিশাল অঙ্কের নগদ টাকার প্রতিটি নোট গুনে নেয় না। এই ফাঁকে প্রতারণা চলে। একই বিষয় খাতুনগঞ্জের ক্ষেত্রেও। পাইকারি ব্যবসায়ীদের নগর লেনদেন হওয়ায় এই ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। টাকার বান্ডিলে একটি করে জাল নোট দিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। যা বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকেই আসে। এক সময় ১শ’ টাকা এবং ৫শ’ টাকার জাল নোটের আধিক্য থাকলেও বর্তমানে ১ হাজারের নোট বেশি জাল।
ফুটপাতের ঈদ বাজার : হকার্সদের কাছে জালনোটের আধিক্য রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে অনেক মৌসুমি হকার্স ফুটপাথে দোকান ভাড়া নিয়ে পোশাক, প্রসাধনী ও জুতা বিক্রি করে। এই বিক্রেতাদের টার্গেট করেই চলে জালনোট ছড়ানোর কাজ। কয়েকশ’ কোটি টাকার লেনদেন হয় চট্টগ্রামের ফুটপাতে ঈদ বাজারে। এই লেনদেনে কয়েক কোটি টাকাই থাকে জাল। যেখানে আসল-নকল টাকা চেনে না অধিকাংশ হকার্স। সেখানে ভুক্তভোগী যেমন বিক্রেতা তেমনি ক্রেতাও। ক্রেতারূপী জালনোট কারবারি থাকে সবচেয়ে বেশি নারী।
টার্গেট বৃদ্ধ এবং এলাকার দোকানি : পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানিদের সিগারেট, বিস্কুট, নুডলস কেনার ছলে এসব নোট ছাড়ানোর কাজে নামে চক্রের সদস্যরা। পাথরঘাটা ও এনায়েত বাজার এলাকার অসংখ্য দোকানি তাদের বক্তব্যে জানিয়েছেন, দুপুরের পর যখন অলিগলিতে ভিড় কমে যায় তখন বেশ কিছু আগন্তুকের আনাগোনা বাড়ে। তারাই ৫শ’ টাকার নোট দিয়ে কেনাকাটা করে। সন্ধ্যার সময় বেচা-বিক্রির চাপ যখন বেশি থাকে তখন তাড়াহুড়ো করে ওই চক্রের কয়েক সদস্য জিনিসপাতি কিনতে আসে। এমন ঘটনা প্রতিদিনের। তবে বৃৃদ্ধ দোকানিদের সবচেয়ে বেশি জালনোট দিয়ে প্রতারণা করেন এই চক্র। যার ফলে নগদ টাকা এবং দোকানের জিনিসপাতি দুইদিকের ক্ষতির শিকার হচ্ছে তারা।
তৈরি হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজর এড়াতে রীতিমতো জালনোট তৈরির আস্তানা গড়ে তুলেছিল কুতুবদিয়ার ৩ সহোদরসহ ৪ জনের একটি সিন্ডিকেট। সরঞ্জামসহ ১৬ লাখ টাকার জাল নোট জব্দ করা হয় ২৭ মার্চ র‌্যাবের এক অভিযানে। তারা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করে ঈদকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় এসব নোট ছড়ানোর পরিকল্পনায় ছিল। শুধু তাই নয়, তারা এই টাকার মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে মাদক ও অস্ত্র কিনত।
মৌসুমি পেশা : ২৯ মার্চ সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বহদ্দারহাট থেকে এক ব্যক্তিকে ৫শ’ ও ১ হাজার টাকার ১ লাখ ৫১ হাজার জালনোটসহ গ্রেফতার করে। হোটেলে চাকরি করলেও এখন এই জালনোটের কারবারে যুক্ত হয়েছিল ওই ব্যক্তি। ঢাকায় সাগর নামে এক যুবক থেকে কিনে এই জাল নোট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, অনেকে মৌসুমি পেশা হিসেবে অধিক লাভের আশায় এই গর্হিত কাজটি করছে। তাই আগে তিন ধাপে জালনোট কারবারিরা সক্রিয় থাকলেও এখন ম্যান টু ম্যান পদ্ধতিতে চলছে এই প্রতারণা।