রমজানের আহবান

20

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ :

সিয়াম সাধনা ও আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে এলো পবিত্র রমজান মাস। হিজরি বর্ষের বারো মাসের মধ্যে নবম মাস হলো রমজান। ফজিলত, রহমত, বরকতের দিক দিয়ে এ মাস অন্য ১১ মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ধর্মপ্রাণ মুসলানদের কাছে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
এ মাসে সিয়াম পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষের ওপর ফরজ করা হয়েছে। ‘সাওম’ বা রোজা ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম। ‘সাওম’ আরবি শব্দ। এর অর্থ বিরত থাকা। ‘সাওম’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘সিয়াম’। শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাওম’। আল্লাহ তা’লা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর ‘সিয়াম’ তথা রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পারো’। (সূরা বাকারা- ১৮৩)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সৎপথ প্রদর্শনকারী ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এই মাসটি পাবে, সে এতে রোজা রাখবে।’ (সূরা বাকারা ১৮৫)।
ফযিলতের দিক থেকে রমজান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।’ তৃতীয়াংশে- অর্থাৎ শেষ দশকে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল ক্বদর’। আল্লাহ তা’লা উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য লাইলাতুল ক্বদরের একরাত্রির ইবাদতকে পূর্ববর্তী উম্মতগণের এক হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে- ‘শবে ক্বদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’। (সূরায়ে ক্বদর)।
রমজান মাসের আগমন হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুবই আনন্দিত হতেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামদের বলতেন, বরকতময় মাস রমজান এসেছে। এ মাসের কিছু ফজিলত বর্ণনা করে বলতেন, ‘আল্লাহ তা’লা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। (নাসায়ি)।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ নিয়ামত দান করা হয়েছে, যা আগেকার উম্মতগণকে দেওয়া হয়নি। এই নিয়ামতগুলো হচ্ছে- ১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে বেশী ঘ্রানযুক্ত। ২. ইফতার পর্যন্ত রোজাদারের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন। ৩. রোজাদারের জন্য প্রতিদিন জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়। ৪. শয়তানকে বন্দি করা হয়। ৫. রমজানের শেষ রাতে সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হয়।
সিয়াম পালনকারী একজন মুসলমান সত্যিকারের খাঁটি ইবাদতকারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীনকে সন্তুষ্ট করার সুবর্ণ সুযোগ হলো পবিত্র রমজান মাস। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে পাপি-তাপি বান্দাদেরকে উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য অধিক পুণ্য অর্জনের বিশেষ অফার নিয়ে আসে পবিত্র রমজান মাস। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয়ই রোজা আমার জন্য, এর প্রতিদান আমিই দান করি’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলো, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলো, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করলো’। (বায়হাকি)।
রমজান মাসের প্রত্যেকটি রোজা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন কারণ ছাড়া ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করে সে যদি অন্য সময় সারা জীবন রোজা রাখে তবুও রমজানের একটি রোজার সমতুল্য হবে না।’
একশ্রেণীর মানুষ পাপিষ্ঠ শয়তানের ধোকায় পড়ে শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া গোপনে সিয়াম ভঙ্গ করে ফেলে। স্মরণ রাখা উচিৎ যে, নিজের প্রতিটি কাজের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ঘরের দরজা বন্ধ করে বা নির্জন স্থানে অবস্থান করলে হয়তো দুনিয়ার মানুষকে আড়াল করা যাবে; কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালাকে আড়াল করা সম্ভব নয়। তিনি সবকিছু দেখেন এবং শুনেন। কোন কারণ ছাড়া মাহে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করলে আল্লাহর দরবারে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
অনেকে রোজা রেখে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। এ রকম সিয়াম পালনের দ্বারা আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জিত হয় না। খানাপিনা, যৌনাচার থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার নামই হচ্ছে ‘সিয়াম’। রোজা রেখে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)।
বছরের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রমজান মাস এলে ধর্মপ্রান মুসলমানরা আনন্দিত হন। প্রত্যেকেই দুনিয়াবি কাজকর্ম সংক্ষিপ্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন। রমজান মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সময়ও সংক্ষিপ্ত করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ অধিক ধর্মপরায়ণ। এ দেশের মানুষ রমজান মাসব্যাপী সিয়াম পালন ও অন্যান্য ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির প্রয়াস চালায়। ইবাদাতের বিশেষ উপলক্ষ্যগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্ঠা করে।
এ মাসে প্রত্যেক মুসলমানের করণীয় হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম পালন করা। অন্যান্য ফরজ ইবাদাতসমূহ গুরুত্বসহকারে আদায় করা। সুন্নাত ও যাবতীয় নফল ইবাদাত পালনে যত্নবান হওযা। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। তাওবা-ইস্তেগফার, জিকির-আজকার ও মোনাজাত করা। হালাল গ্রহন ও হারাম থেকে থেকে বেঁচে থাকা। কাউকে গালি না দেওয়া। গীবত না করা। চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি না করা। সন্ত্রাস, খুন, গুম, ধর্ষণ, যেনা-ব্যভিচার না করা।
রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। এ মাসে যাবতীয় অশ্লিলতা ও বেহায়াপনা থেকে বেঁচে থাকা, দিনের বেলা হোটেল রেস্তেরা বন্ধ রাখা। সেহরী, ইফতার ও তারাবিহের সময় যাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিং না হয় সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রমজানে চাল, ডাল, তেল, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সুযোগে অধিক মুনাফালাভের আশায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। এবার রমজানের অনেক আগে থেকেই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজমান। যা রমজান মাসে আরো বেড়ে যেতে পারে। আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন আরব দেশে রমজান মাস আসার আগেই পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশে মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টো। এখানে রমজান মাস আসার আগেই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এছাড়াও পণ্যে ভেজাল দিয়ে আমাদের খাবারকে দূষিত করা হচ্ছে। ভেজাল মিশ্রিত খাবার গ্রহণের ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে অসৎ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অপকৌশলের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।