গণহত্যা স্মরণে এক মিনিট গোটা দেশ ব্ল্যাকআউট

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
২৫ মার্চের জাতীয় গণহত্যা স্মরণে শুক্রবার রাতে এক মিনিটের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। এক মিনিট নিঃশব্দ ছিল গোটা দেশ। রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত দেশজুড়ে পালিত হয়েছে প্রতীকী ব্ল্যাকআউট তথা নীরবতা পালন কর্মসূচী।
কেপিআইভুক্ত এলাকা (জরুরী স্থাপনা) ও চলমান যানবাহন ছাড়া সারাদেশের মানুষ এ সময় দাঁড়িয়ে ও সব আলো নিভিয়ে একসঙ্গে নীরবতা পালন করে। গোটা জাতি শ্রদ্ধা আর অবনতমস্তকে স্মরণ করে সেই মানুষদের, যারা একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া মশাল প্রজ্বালন, আলোর মিছিল, বিভীষিকাময় সেই কালরাতের স্মৃতিচারণ আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শুক্রবার ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হয়েছে ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত্রি স্মরণে নানা অনুষ্ঠানমালার। রাতে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও নতুন প্রজন্মের হাতের মশাল আর হাজারও প্রজ্বালিত মোম থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা। আলোর মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আলোচনা সভা, স্মরণসভা, প্রদীপ প্রজ্বালন করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বীর শহীদদের প্রতি। পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কৃতজ্ঞ হাজারও মানুষ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনা ও স্মরণ সভায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে যেকোন মূল্যে রুখে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। দিবসটি পালনে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি ছিল প্রচন্ড। পাকি হন্তারকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার জানানো হয় প্রতিটি অনুষ্ঠানে।
পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে পরাজিত পাকিস্তানের নতুন ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। একাত্তরের গণহত্যার কথা এখনও অস্বীকার করে পাকিস্তান। বাঙালির জাতির আত্মপরিচয় ও মর্যাদার ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচারের জবাব দিতেই ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন।
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ‘জোনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জোনোসাইড ওয়াচ’। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা এই স্বীকৃতির খবর জানায়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী এখন ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে বিষয়টি আরও বেশি করে জানানোর কাজটি করতে হবে। জেনোসাইড ওয়াচ বলেছে, জেনোসাইড ওয়াচ এই স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালীদের ওপর যেসব অপরাধ করেছে, তার মধ্যে ছিল ‘জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ।’
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। জাতীয় কর্মসূচীর মধ্যে ছিল- এক মিনিটের প্রতীকী ব্ল্যাকআউট। রাত ৯টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ অন্ধকারে ঢেকে যায়। কেপিআইভুক্ত এলাকা (জরুরী স্থাপনা) ও চলমান যানবাহন ছাড়া সারাদেশের মানুষ এ সময় দাঁড়িয়ে ও সব আলো নিভিয়ে একসঙ্গে নীরবতা পালন করে।
গোটা জাতি শ্রদ্ধা আর অবনতমস্তকে স্মরণ করে সেই মানুষদের, যারা একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানান একাত্তরের সেই গণহত্যাকারী এবং তাদের দোসরদের প্রতি। যারা এখনও সারাদেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে। সারাদেশে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এবং একাত্তরের মতো আবারও তাদের পরাজিত করে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে দৃপ্ত শপথ নিয়েছেন।
এছাড়া বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং সকল জেলা ও উপজেলায় ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভাসহ সারাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন সীমিত পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান বীর শহীদদের। একইভাবে ঢাকাসহ সারাদেশেই ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ করা হয়।
একাত্তরের গণহত্যার ওপর একটি সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যারা গণহত্যা চালিয়েছে সেই পাকিস্তানীদের কোন বিচার হয়নি, যা ওই দেশের (পাকিস্তান) জন্যও লজ্জাজনক।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের উচিত ছিল তাদের বিচার করা। এমনকি তাদের যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তারাও সুপারিশ করেছিল বিচারের। কিন্তু সেটি তারা করেনি। আমি আশা করব পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম বিষয়টির গুরুত্ব্র্র অনুধাবন করে এটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের কবর থেকে তুলে এনে তাদের বিচার করবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর পশ্চিম কমিটি শুক্রবার সকাল ১০টায় মিরপুরে নুরি মসজিদ জল্লাদখানা বধ্যভূমি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি ও মহানগর দক্ষিণ কমিটি সকাল ১১টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটি সূর্যাস্তের সময় জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণশহীদদের স্মরণে আলোক প্রজ্বালন করে।
জাতীয় গণহত্যা দিবস ২০২২ উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের গণহত্যার পাঁচ দশক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র। বাংলা একাডেমির শামসুর রহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক কবি আসাদ মান্নান প্রমুখ। গণহত্যা বিষয়ক কবিতা পাঠ করেন কবি তারিক সুজাত।