ভালোবাসার নাম ‘মা’

12

মো: শামসুল ইসলাম সাদিক :

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বলা হয়েছে, তোমার প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ভিন্ন অপর কারও ইবাদত করো না। পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করো। যদি তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার নিকট উপনীত হয়; তবে তাদের কখনো ‘উহ’ শব্দ পর্যন্ত বলবে না। তাদের ধমক দেবে না বরং তাদের সঙ্গে মার্জিত কথা বলবে। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনুগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত করবে। আর বল, (তাদের জন্য দোয়া কর) হে আমার প্রতিপালক তাদের উভয়কে অনুগ্রহ কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছে। (সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪)। পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ছোট্ট একটি শব্দ হচ্ছে ‘মা’। মায়ের মতো এমন মধুর শব্দ অভিধানে দ্বিতীয়টি আর পৃথিবীর কোথাও নেই। ‘মা’ শব্দটি ছোট হলেও এর বিশালতা আকাশের চেয়েও বড়। ‘মা’ বলতেই চোখের সামনে মায়ের সদা হাস্যময়ী ও শান্তির চেহারা ভেসে ওঠে। ‘মা’ শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা,শীতল পরশ, অকৃত্রিম স্নেহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার চাবি। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা প্রশ্নই উঠে না। মায়ের তুলনা মা নিজেই। মায়ের কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু এর গুরুত্ব এবং মযার্দা কতটুকু তা বলে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নদীর তলদেশ নির্ণয় করা যায় কিন্তু মায়ের ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু এমন দয়ালু এবং মযার্দাবান মানুষটিকে আমরা কতটা সম্মান এবং ভালোবাসা দিচ্ছি? আমাদের যে ‘মা’ দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে তিল তিল করে আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মায়ের কষ্ট বহুগুণে বেড়ে যায়। রাতের পর রাত জেগে সন্তানের দেখভাল করলেও মায়ের কোনো ক্লান্তি হয় না। সন্তানের সুখের জন্য হাসিমুখে সব কিছু বিলিয়ে দিতেও ‘মা’ কার্পণ্য করেন না। সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়ির যে সম্পর্ক রয়েছে তা কখনো ছিন্ন হবার নয়। এই সুন্দর পৃথিবীতে মুক্তভাবে শ্বাস নিতে দিচ্ছে, আমরা সেই ‘মা’কে বিনিময়ে কি দিচ্ছি? আমরা বিনিময়ে আসলে কিছুই দিতে পারব না। কারণ মায়ের ঋণ কেউ শোধ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
মায়ের কাছে একটি সন্তান যেমন তার জগৎ তেমনি সন্তানের কাছে তার ‘মা’-ই সব। আর এজন্য ‘মা’ এবং সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কটি সবচেয়ে মধুর। একটি সন্তান যখন খেতে পারে না কথা বলতে পারে না এমন কি নিজের কাজ নিজেও করতে পারে না তখন তাকে আগলে রাখেন মমতাময়ী ‘মা’। তার পরম মমতার চাদরের উষ্ণতায় আগলে রেখে বড় করে তোলেন। সন্তানের সব আবদার ‘মা’ হাসি মুখে মেনে নেন। কিন্তু আমাদের যতটুকু মাকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার কথা ততটুকুই কেউ সঠিকভাবে মাকে দিই না। শত কষ্টের মাঝেও ‘মা’ তার সন্তানের গায়ে একফোঁটা আঁচড় লাগতেও দেয় না। সন্তানের হাসি যেন মায়ের হাসি হয়ে যায়। হযরত আবু উমামা (রা:) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (সা:)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্তানের উপর পিতা-মাতার কী হক আছে? তিনি বললেন তারা তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)- আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? রাসূল (সা:) বললেন, তোমার ‘মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, অতঃপর কে? রাসূল (সা:) বললেন তোমার ‘মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? এবারও জবাব দিলেন, তোমার ‘মা’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কে? এবার রাসূল (সা:) জবাব দিলেন, তোমার ‘বাবা’। (বুখারী ও মুসলিম)।
‘মা’কে ঘিরেই সন্তানের শৈশব-কৈশোর আবর্তিত হয়ে থাকে। মা তারুণ্যের পথপ্রদর্শক ও প্রেরণার উৎস হিসেবে সন্তানের পাশে চাদরের মতো জড়িয়ে থাকেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মা এই শব্দটি উচ্চারণ করার মধ্যেই অবধারিত সুখের ও শান্তির সন্ধান পাওয়া যায়। সে কারণে একটু আঘাত পেলে মনের অজান্তে মুখ থেকে ‘মা’ শব্দটি উচ্চারিত হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা একবার হারিয়ে ফেললে তা কখনোই ফিরে পাওয়া সম্ভব না। যে সম্পর্কে রয়েছে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা। শিশুকাল থেকে এ পর্যন্ত মায়ের কাছে শুধু হেরেই গেলাম। কোন দিন জিততে পারিনি। এই মুহূর্তে আমার জনম দু:খিনী মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। যে কোন দুর্ঘটনা কষ্টের আর তা যদি হয় ‘মা’ জননী তাহলে তো সহ্য করা কঠিন। যদিও একশ্রেণীর মানুষ ক্ষমতার দাপটে অন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালের ১২ জুন আমার গর্ভধারিনী ‘মা’কে চিরদিনের জন্য এবং ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর মাথার ছাতা প্রিয় ‘বাবা’কে হারিয়ে এতিম আমি। যাই হোক, প্রতিটি সন্তান জানে আমাদের ‘মা’ আমাদের জন্য কতটা কষ্ট করে এবং কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আমার প্রশ্ন আমরা আমাদের মাকে কতটা ভালোবেসেছি? কিন্তু ‘মা’ তো তার ভালোবাসা অন্তরে রেখে দেয় নি, তিনি তার ভালোবাসা আমাদের দিয়ে দিচ্ছেন নিঃশ্বার্থ ভাবে। আমরা এমনো কিছু সন্তান রয়েছি যারা মাকে ভালোবাসতে পারি না বরং কষ্ট দিতে জানি। আমরা এমনিতে সমাজের সামনে লোক দেখানো মায়ের প্রতি ভালোবাসা অধিক পরিমাণে দেখাই। ‘মা দিবস’ আসলে লাফিয়ে লাফিয়ে বলি ‘মা’ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ফেসবুকে মায়ের জন্য ভালোবাসার বাণী লিখে উড়িয়ে ফেলি। আমরা অসুস্থ হলে ‘মা’ আমাদের জন্য পারে না জীবনটা দিয়ে দিতে। তখন ‘মা’ আমাদের জন্য কি করে কিংবা কেমন করে সেটা আমরা ভালো ভাবেই জানি। কিন্তু আমরা মায়ের অসুস্থতার সময় কি করেছি? কখনো জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা’ তুমি কেমন আছো?’। কখনো কি জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা’ তোমার শরীর ভালো আছে কি?’ আমরা কিন্তু সামান্য মাথাব্যথা হলেও মাকে এসে বলি, ‘মা আমার ভালো লাগছে না।’ কিন্তু মায়ের গুরুতর অসুখের কথাও আমাদের কখনো বলে না কিংবা আমরা জানতে চেষ্টা করি না। শরীরে অসুস্থতা নিয়েও রান্না করে যায় প্রিয় খাবারটি। ঘরের সব কাজ নিশ্চুপভাবে করে যায়। বুঝতে দেয় না কষ্ট হচ্ছে। মা কখনোই বলে না আর পারছে না। আর আমরা কয়জনেই বা বুঝতে চেষ্টা করি। আমরা তখন নিজেরা একটু বেশিই বুঝি এরপর মায়ের ভুল ধরতে শুরু করি। মাকে ধমক দিতে শুরু করি। মা আমাদের কিছু বারণ করলেও আমরা সেটা তেমন তোয়াক্কা করি না। আমরা নিজেদের মতো নিজেরাই চলি। আমরা একবারও চিন্তা করিনা আমাদের যে মানুষটি শূন্য থেকে এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে তার জন্য কিছুই করতে পারি না। এদিক থেকে চিন্তা করলে আমরা নিজেরাই বিবেকহীন এবং অসৎ। কারণ আজ আমাদের যাদের মা নেই। যখন ছিল তখন হয়তো সেই সুযোগটি পাইনি। আজ সময় এসেছে কিন্তু ‘মা’ নেই। এমনো হাজারো ‘মা’ হারা সন্তান এই সমাজে রয়েছে। কিন্তু যাদের আছে তারা মাকে কতটুকু সম্মান কিংবা ভালোবাসা দিচ্ছি। সমাজে এমনও কিছু সন্তান রয়েছে যারা তার জন্মদাত্রী মায়ের শরীরে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু সেই ‘মা’ গুলোর অপরাধ কি, সন্তানকে জন্ম দেওয়া, শিশু কালে লালন পালন, নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ানোটা। মা কখনোই আমাদের শাস্তি দেয় না। কারণ সন্তানের জন্য মায়ের মনে ভালোবাসা ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। আমরা অপরাধ করলে মা সবসময় আমাদের ক্ষমা করে দেয়। ‘মা’ শুধু চায় আমরা যেনো ভালো ও সুন্দর থাকি। মা যদি না ফেরার দেশেও চলে যায় সন্তানের মঙ্গল কামনা সেখান থেকেও করবে। কারণ সে তো ‘মা’। ‘মা’ চায় আমরা শুধু তাকে ‘মা’ বলে ডাকি আর একটু ভালোবাসি। কিন্তু আমরা মাকে ‘মা’ ডাকার মতো সময়ও আজকাল পাই না। ‘মা’ তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে অনেক অনেক খুঁজি আমরা, কিন্তু পাবো না। আমি পেয়ে হারিয়ে ফেলছি মাকে। তবু জানি সন্তান মাকে কষ্ট দিয়ে থাকলেও ‘মা’ সেটা ভুলে যাবে এবং সন্তানকে ক্ষমা করে দিবে। এটাই মায়ের নিয়ম। তবুও আজ বলতে চাই, ‘ক্ষমা করে দিও মাগো’। ‘মা’ তোমায় সত্যি ভীষণ ভালোবাসি।