অগ্নিঝরা মার্চ

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৫ মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাদা রঙের গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৬ মার্চ শুরু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকেই তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ।
অপরদিকে দেশবাসী তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। দেশবাসীকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদস্বরূপ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের খেতাব বর্জন অব্যাহত রাখেন। চারদিকে শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন।
একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক ক্যাম্পাসে দুজন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করেন। এটিই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন একমাত্র পদত্যাগ।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ খেতাব বর্জনের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সব শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জনের আহ্বান জানান। দেশবাসী আরও বেশি উৎসাহ ও উদ্দীপনা পেয়ে নিজেদের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। এ দিনের ঢাকা শহরে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সবার সভা-সমাবেশ চলতেই থাকে।
একাত্তরের এ দিনে অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্যে রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদ এদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাঁদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মজিদ। বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ফরিদ আলী, শওকত আকবর, আলতাফ হোসেন, রওশন জামিল, আলেয়া ফেরদৌস প্রমুখ।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলো’তে লিখেছেন, ‘… সিঁড়ির মুখ থেকে জামী চেঁচিয়ে ডাকল, মা, ভাইয়া, শীঘ্রই এসো, খবর শুরু হয়ে গেছে। টিভিতে শেখ মুজিবকে দেখাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে নিচে ছুটলাম। খবর খানিকটা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের গাড়িতে পতপত করে উড়ছে কালো পতাকা। দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। প্রতিবাদের কালো পতাকা উঁচিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছেন শেখ মুজিব। এর আগে কোনদিনও পাকিস্তান সরকার বাঙালীর প্রতিবাদের এই কালো পতাকা স্বীকার করে নেয়নি। এবার সেটাও সম্ভব হয়েছে।’
জাহানারা ইমাম সেই সময়কার বিবরণ দিতে গিয়ে আরও লিখেছেন, ‘…সারা দেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে, ঢাকায়, রাজশাহীতে, চট্টগ্রামে- সবখানে এই দাবি তুলে শান্তিপ্রিয় বাঙালীরা আজ মরিয়া হয়ে ওঠে, লাঠি-সড়কি যা পাচ্ছে তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলির সামনে। ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা, পটকা, মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর।’
একই দিন ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরেও সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং চলতে থাকে। এদিনে নেত্রকোনায় সুইপার ও ঝাড়ুদাররা ঝাড়ু, দা, লাঠি ও কোদাল নিয়ে মিছিল বের করে। বগুড়া, খুলনা, রংপুর, লাকসাম, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার স্বপক্ষে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।