পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সহ ৪৫ উপজেলায় ৮ হাজার যত্ন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ ॥ তিন বছরে সাঁতার শেখানো হবে তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ১০ হাজারই থাকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। ডুবে শিশুদের এভাবে প্রাণহানি রোধে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের কার্যক্রমও পরিচালিত হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বাবা-মায়েরা যখন কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন শিশুরা বেশি পানিতে ডুবে মারা যায়। এজন্য ওই সময়টা শিশুদের নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে পারলে এই মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব
গত ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) ‘ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ নামে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সহায়তায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশু একাডেমির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৬ জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার শিশু যত্ন কেন্দ্র করা হবে। গবেষণায় মোতাবেক পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ সময় অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শিশুরা এসব কেন্দ্রে থাকবে। কেন্দ্রে পাঁচ ঘণ্টা থাকার সময় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সহায়ক নানা শিক্ষা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এই ৪৫ উপজেলায় এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী দুই লাখ শিশু কার্যক্রমটির আওতায় আসবে।
একই সঙ্গে এই ৪৫ উপজেলায় ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতাভুক্ত অঞ্চলের দুই লাখ মা-বাবাকে সচেতন করা হবে, যেন তারা শিশু যত্ন, সুরক্ষা এবং বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেন।
২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বাংলাদেশ হেলথ ও ইনজুরি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ পানিতে ডুবে মারা যায়। জরিপ অনুযায়ী, প্রতিদিন ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া প্রতি বছর বাংলাদেশে সব বয়সের প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ১০ হাজারই থাকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।
কেন্দ্রে শিশুরা সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত থাকবে। ছড়া, গানসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বিকাশের কাজগুলো করা হবে। দুপুরে যেন তাদের একটা খাবার দেওয়া যায়, যেটা তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রাউনিংয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক থেকে চার বছরের শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশই মারা যায় পানিতে ডুবে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে বেসরকারি সংস্থার কিছু উদ্যোগ থাকলেও এতদিন সরকারের দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো কার্যক্রম ছিল না। ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ এবং শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ নিয়ে এই প্রথম বড় আকারে প্রকল্প নিলো সরকার। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে আশার আলো দেখছেন তারা।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান) অনুবিভাগ মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়েছে। রেজুলেশন অনুমোদনের পর আমরা যখন পাবো, এরপর কাজ শুরু হয়ে যাবে। প্রকল্প পরিচালক বা পিডি নিয়োগ দেওয়া হবে। আমাদের দিক থেকে অন্যান্য পদগুলো পূরণ করে দেবো।’
তিনি বলেন, ‘যে বিষয়টিতে আমাদের নজর ছিল না, সেই বিষয়ে আমরা কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। এটা খুবই আনন্দের বিষয়।’
অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। প্রকল্প নেওয়ার আগে গবেষণা হয়েছে। কোন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ, তা সেখানে উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বাবা-মায়েরা যখন কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন শিশুরা বেশি পানিতে ডুবে মারা যায়। এজন্য ওই সময়টা শিশুদের নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে পারলে এই মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে ওই সময়টায় শিশুদের শিক্ষামূলক নানা কর্মকাণ্ডে রাখা যেতে পারে, যেন শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশটা হয়। সেই অনুযায়ী নতুন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।’
‘এই প্রকল্পের আওতায় আমরা শিশু যত্ন কেন্দ্র করবো। সরকার ও এনজিওদের সহায়তায় ১৬ জেলায় আট হাজার কেন্দ্র করা হবে। সবার সহযোগিতায় শিশু একাডেমি মূলত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।’
এই প্রকল্পের আওতায় ছয় থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর এক লাখ ২০ করে তিন বছরে তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে।’
মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘বাস্তবায়নে গেলে দেখা যাবে, কী কী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। তখন আমরা বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করব। এটাকে আমরা যদি প্রথম পর্ব বলি, এটার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আমরা যদি সফল হই, ইতিবাচক ফল আসে তাহলে আমরা এটা দেশব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেবো। তবে সার্বিকভাবে বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করে। কারণ এর সঙ্গে অর্থের সংশ্লিষ্টতা আছে।’
যে ৪৫ উপজেলায় নেওয়া হবে প্রকল্প :
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দেশের ১৬ জেলা তথা বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এর মধ্যে বরগুনার আমতলী, বেতাগী, তালতলী; ভোলার সদর, লালমোহন, মনপুরা; পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা, বাউফল; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর; চাঁদপুরের সদর, মতলব দক্ষিণ, মতলব উত্তর; নরসিংদীর মনোহরদী; বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লারহাট, শরণখোলা; সাতক্ষীরার দেবহাটা, শ্যামনগর; ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল, নান্দাইল উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
এছাড়া নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, দুর্গাপুর, মদন; শেরপুরের সদর, নলিতাবাড়ী, শ্রীবরদী; সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, রায়গঞ্জ, তাড়াশ; নিলফামারীর ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর; হবিগঞ্জের বাহুবল, মাধবপুর, আজমিরিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর, দেওড়া বাজার উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।
যা আছে প্রকল্পে :
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ (ইসিডি) বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্পের পরামর্শক মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশ নিয়ে একটি সমন্বিত নীতি অনুমোদন করে। এই নীতিতে বলা হয়েছে, শিশুর যে চাহিদা সেটা অনুযায়ী একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হলো মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আমরা হয়তো শিক্ষার দিকে ফোকাস দেই, কেউ হয়তো পুষ্টি নিয়ে কাজ করে, কেউ স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। কিন্তু শিশুর সমন্বিত যত্ন একটি সেন্টারে এনে কীভাবে করা যায়, সেটি ভাবা হচ্ছিল। শিশুমৃত্যুর হার কমানো সরকারের একটি বড় লক্ষ্য। সেই প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্টাডি রয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশেও স্টাডি হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বিভিন্ন রোগে যেমন শিশুরা মারা যায়, পানিতে ডুবে মারা যায় এর চেয়েও বেশি। পানিতে ডুবে এত শিশু মারা যাওয়ার কারণ হলো, গ্রামাঞ্চলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত শিশুরা আনসুপারভাইসড থাকে (দেখাশোনার কেউ থাকে না)। দেখা যায়, বাবারা বাইরে কাজে থাকেন, মায়েরাও গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত থাকেন।’
‘তাই শিশুদের এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে যদি একটি স্থানে রাখা যায়, তবে তারা নিরাপদ থাকবে, সেখানে সহায়ক কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে একই সঙ্গে তাদের প্রারম্ভিক বিকাশও হবে।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মূলত একটি মডেল আমরা করছি। একটি সেন্টার হবে। সেখানে শিশুরা আসবে, তাদের বিকাশের জন্য যে বিষয়গুলো প্রয়োজন; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি- সব বিষয়ই সেখানে নিশ্চিত করা হবে। এই শিশু যত্ন কেন্দ্রগুলো হবে এক থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের জন্য। কেন্দ্রে শিশুরা সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত থাকবে। ছড়া, গানসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বিকাশের কাজগুলো করা হবে। দুপুরে যেন তাদের একটা খাবার দেওয়া যায়, যেটা তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে।’
‘শিশুর ব্রেন ডেভেলপমেন্টের (মস্তিষ্কের বিকাশ) ৮০-৯০ শতাংশ হয়ে যায় প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে। এ সময়ের ওপরই নির্ভর করে শিশু কেমন মানুষ হবে’ বলেন তারিকুল ইসলাম।
প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৬ জেলায় আট হাজার শিশু যত্ন কেন্দ্র করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই লাখ শিশুকে সেখানে রাখা হবে। প্রতিটি সেন্টারে সর্বোচ্চ ২৫ জন শিশু ভর্তি করা হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন নারী যত্নকারী (কেয়ার গিভার) থাকবেন, তার সঙ্গে থাকবেন একজন সহকারী, তিনিও হবেন নারী। যিনি যত্নকারী হবেন তার বাড়িতে কিংবা তার অন্য কোনো স্থানে সেন্টারটি হবে। সেন্টার ভাড়া করার কোনো বিষয় থাকবে না। কমিউনিটিই এটি ম্যানেজ করবে। যত্নকারীর সম্মানী হবে পাঁচ হাজার টাকা ও সহকারীর সম্মানী হবে চার হাজার টাকা।’
শিশু যত্ন কেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় নারীরাই হবেন যত্নকারী ও সহকারী যত্নকারী। এক্ষেত্রে ১৬ হাজার নারীর কর্মসংস্থান হবে। তাদের সাত দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া প্রতি বছর তারা রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ পাবেন।
‘যত্নকারী ও সহকারী যত্নকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা আমরা এসএসসি পাস বলেছি। তবে ইউএনওর নেতৃত্বে একটি কমিটি প্রস্তাব করা আছে। কোন গ্রামে এই শিক্ষাগত যোগ্যতার কাউকে পাওয়া না গেলে, কমিটি যদি মনে করে আরও কম শিক্ষাগত যোগ্যতার কাউকে দেবে, সেটা তারা পারবে।’
এখন নানা কারণে শিশুদের সাঁতার শেখা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শিশুদের সাঁতার শেখাতে পারি তবে তাদের পানিতে ডুবে মৃত্যু থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এই প্রকল্পের আওতায় ছয় থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে। এজন্য চার হাজার ৮০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি লিঙ্ক করা হবে। শিশু বাছাই করে স্কুলের পাশে যে পুকুর আছে সেই পুকুরকে সাঁতার উপযোগী করে সেখানে সাঁতার শেখানো হবে। এক্ষেত্রে সাঁতার শেখার আরএনএলআই (যুক্তরাজ্যের রয়েল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট) মডেল অনুসরণ করা হবে। তিনটি স্তরে শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে। এই কাজ করা হবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানেই।’
তারিকুল ইসলাম জানান, ১৬ জেলায় তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের এক হাজার ৬০০ জন সাঁতার প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।
‘এই প্রকল্পের আওতায় শিশুদের লালন-পালন ও যত্ন নেওয়ার বিষয়ে মা-বাবাদের সচেতন করা হবে। প্রতি মাসে বাবা-মাকে নিয়ে একটি সেশন হবে। শিশুর যত্ন, বিকাশ কিংবা শিশু পানিতে ডুবলে কী করতে হবে- সেই সব বিষয় থাকবে সেশনে। যে শিশুরা সেবা পাবে তাদের পরিবারকে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হবে না।’
এনজিও ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্যদের নিয়ে শিশু বিকাশের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তারিকুল ইসলাম।
‘এখন এনজিওদের একটি কার্যক্রম আছে, আঁচল নামে সেটি পরিচালিত হচ্ছে। অনেক আঁচল কেন্দ্র হয়তো এই প্রকল্পের অধীনে চলে আসবে। আঁচলের অনেক কম্পোনেন্ট হয়তো থাকবে প্রকল্পে।’
এছাড়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিটি ইউনিয়নে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ নিয়ে একটি করে কমিটি করে দিয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান হচ্ছেন সেই কমিটির প্রধান। আমরা ওই কমিটির কাছে প্রস্তাব করবো শিশু যত্ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য। সেখানে শিশুদের নিয়ে জরিপ হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইসিসিডিতে (শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশ) সমন্বিতভাবে কীভাবে কাজ করা যায় এটার একটা মডেল ভারতে রয়েছে। সেই মডেলটি দেখার জন্য পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে প্রকল্পে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে দুটি টিম করা হবে, প্রতি টিমে আটজন করে থাকবে। তারা পাঁচদিনের সফরে ভারতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সেন্টারগুলো দেখবেন, শিশু যত্ন কেন্দ্রে কীভাবে সমন্বিতভাবে কাজ হচ্ছে। এজন্য ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’
‘আর শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধের এই কার্যক্রম আমাদের কাছে নতুন। তাই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সেমিনার হবে, সেখানে এই প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অংশ নেওয়ার সুযোগের জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই মোট ৫০ লাখ টাকা পুরো প্রকল্প সময়ের জন্য রাখা হয়েছে। এখানে সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যাওয়ার কোনো বিষয় নেই। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়টি বলা হচ্ছে।’
প্রকল্পটি তিন বছর মেয়াদী। ২০২৪ সালের ৩০ জুন এর মেয়াদ শেষ হবে। গ্রাউন্ডওয়ার্ক বা মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। ম্যানুয়ালগুলো তৈরি করা হচ্ছে, কীভাবে ট্রেনিং হবে সে বিষয়ে। ডোনারদের সঙ্গেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কথা হচ্ছে, তারা কারিগরি সহায়তা দেবে। একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্পের প্রশাসনিক অর্ডার হলে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হবে। তারপর কাজ পুরোদমে শুরু হবে।
প্রকল্প ব্যয়ের ৮০ শতাংশ টাকা (২১৭ কোটি ৬১ লাখ ৮৪ হাজার) আসবে সরকারের তহবিল থেকে। বাকি ২০ শতাংশ (৫৪ কোটি ২০ লাখ ৭৩ হাজার) টাকা অনুদান হিসেবে দেবে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোর্ড ইনস্টিটিউশন ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ।
আশার আলো দেখছেন বিশেষজ্ঞরা :
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতি, আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনের সমর্থনে কাজ করে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)। সংস্থাটির বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অ্যাডভোকেসি করছিলাম। আমাদের আরেক সহযোগী সংস্থা সিনারগোজ এ বিষয়ে ডিপিপি প্রণয়নের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছিল। আমরা অ্যাডভোকেসি করছিলাম। ইস্যুটা নিয়ে কাজ করছিলাম।’
‘গ্রামের অনেক মানুষ মনেই করতো শিশুরা যে পানিতে ডুবে মারা যায়, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু। এটা যে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা বোঝাতে আমরা বিভিন্ন সাব-রিজিওনাল, রিজিওনাল ওয়ার্কশপসহ কর্মকাণ্ড করেছি। এর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। একটা পাবলিক ডিমান্ডও তৈরি করার চেষ্টা করেছি আমরা। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, এই প্রকল্পটি দরকার। এরপর সরকার এগিয়ে এসেছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছে।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘ইতোমধ্যে সিআইপিআরবি এবং জন হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে আঁচল নামে একটি দিবা যত্ন কেন্দ্র মডেল করেছে। এটি বাংলাদেশে ক্লিনিক্যালিও এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজের অর্থায়নে আড়াই হাজার আঁচল সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। আঁচল মডেলটির অনুসরণে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি এটি সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ।’
প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়নে তেমন সমস্যা হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে লোকাল কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে, সেই সুফল যেন মানুষ পায়, তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।’
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ২০০৫ থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি)। সংস্থার উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা গবেষণা করি। গবেষণা থেকে আমরা একটা প্রোডাক্ট বের করেছি। কী করলে পানিতে ডুবে শিশু মারা যাবে না। শিশুদের সাঁতার শেখানো এবং যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নজরদারিতে রাখলে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। শিশুদের যদি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখে-শুনে রাখা যায় তবে তাদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় ৮০ শতাংশের মতো কমে যায়। এটা গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণালব্ধ প্রোডাক্টটি নিয়ে তো বসে থাকলে হবে না। এটি ছড়িয়ে দিতে হবে, বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এটা তো আমরা করতে পারবো না। সরকারই বিস্তৃত পরিসরে তা করতে পারবে।’
‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সেই পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। পানি ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এটাকে (ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে শিশুকে সেন্টারে রাখা ও সাঁতার শেখানো) রিকমেন্ড করে। সরকারও তার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী। এটা যেন সরকারের মূল স্রোতের কর্মকাণ্ডের মধ্যে চলে আসে।’
আমিনুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় যে কাজগুলো হবে, সেগুলোর পরিকল্পনাটা খুব ভালো হওয়া দরকার। বাস্তবায়ন ঠিক মতো হচ্ছে কি না, সেই মনিটরিংটা করা দরকার। এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সরকার অন্যান্য দেশের কাছে অনুসরণীয় হতে পারে।’