কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি কাজ করেন নারী ॥ আজ বিশ্ব নারী দিবস

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে কর্মজীবী নারী তিনগুণ বেশি কাজ করে। দেশে বর্তমানে সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি নারী ও পুরুষ কর্মজীবী। গড় হার পুরুষ ৭০ শতাংশ ও নারী ৩০ শতাংশ। কৃষি ও গার্মেন্টে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হওয়ার আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। জন প্রশাসন ও অন্যান্য চাকরিতে নারী পুরুষের আনুপাতিক হার এখনও ৫০: ৫০ হয়নি। দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং নারীর কাজের গতি পুরুষের চেয়ে বেশি হওয়ায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের ৫ম অধ্যায়ে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হয়েছে নির্ধারিত সময়েই তা অর্জিত হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) পূরণে হাতে সময় আছে আট বছর। ২০১৬ সালে এসডিজি শুরু হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোর এসডিজি পূরণের কথা বলা হয়েছে। এসডিজিতে রয়েছে ১৭টি অধ্যায়। বাংলাদেশ এসডিজির সবগুলো অধ্যায় নিয়ে কাজ করছে। এসডিজির পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে ‘জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’ বা নারী পুরুষের সমতা। দেশে নারী পুরুষের সমতায় হাতে গোনা কয়েকটি সেক্টর কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে বেশিরভাগ সেক্টর এখনও জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির অবস্থানে নেই। এই সেক্টরগুলোকে চিহ্নিত করে ইক্যুয়ালিটি বাস্তবায়নের কাজ চলমান।
অতীতে বেশিরভাগ নারী শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন। শিল্প খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। একবিংশ শতকে কর্মজীবী নারীর চিত্র অতীতের চিত্রের চেয়ে বিস্তর ফারাক। এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারী কর্মজীবী নেই। জন প্রশাসন, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সেনাবাহিনী, বিমান সেনা, নৌ সেনা, সিভিল এভিয়েশন, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, স্বাস্থ্য, ব্যাংক বীমা, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান, নির্মাণকর্মীসহ বিভিন্ন শাখা মিলে দেড় কোটির বেশি নারী প্রধান নির্বাহী, শীর্ষ নির্বাহী, উচ্চপদের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পদে নিয়োজিত আছেন। গণমাধ্যম ও শিল্পী সত্তার পেশাকেও বেছে নিচ্ছে নারী। এর বাইরে কৃষি কাজে প্রায় দেড় কোটি ও শিল্প খাতে অন্তত ৫০ লাখ নারী শ্রমিক রয়েছেন।
সূত্র জানায়, গার্মেন্ট শিল্পে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের অনুপাত ৭৫ ঃ ২৫ অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগই নারী শ্রমিক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় তারা ‘ইকোনমিক্যালি এ্যাকটিভ’। তারা কাজের জন্য বেতন ও মজুরি পাচ্ছেন এবং মূল্য সংযোজন অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির মূলধারায় নারীর অবদান দিনে দিনে বাড়ছে। বিবিএস সূত্রের হিসাব, প্রতি বছর গড়ে অন্তত দুই লাখ করে নারী কৃষি শিল্প ও সেবা খাতে যোগ হচ্ছে। একটা সময় জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল কম। বর্তমানে তা পাল্টে গিয়েছে। সিভিল সার্ভিসে নারীর অংশগ্রহণ এখন অনেক বেশি।
অর্থনীতির মূলধারার স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেক নারী। অর্থনীতির বৃহত্তর তিনটি বড় খাত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলে গেল শতকের শেষ দশকেও কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে কম ছিল। কৃষিতে যন্ত্র যুগের দ্রুত আবির্ভাবে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফসলের মাঠে পুরুষই অলস সময় কাটায় বেশি। বর্তমানে নারী কৃষক সকালের কাজ সেরে পাওয়ার টিলার নিয়ে জমিতে যায়। চারা রোপণের কাজ করে নারী। সেচসহ পরিচর্যার অর্ধেকের বেশি কাজ, ধান সিদ্ধ শুকানোর কাজ করে নারী। মরিচ প্রধান বগুড়া অঞ্চলে মরিচের আবাদ থেকে শুরু করে লালমরিচ বস্তা ভরা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ করে নারী। মরিচের তীব্র ঝাঁজের কারণে সাধারণত পুরুষরা কাজে যায় না। নারীকে ঠেলে দেয়। যন্ত্রে ধান মাড়াই কাটাইয়ের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে বেশি। আগের অংশগ্রহণ ছিল আধাআধি। আবাদ পরিচর্যার সঙ্গে শিশু পরিচর্যাও করতে হয় নারীকে। নারীকেই করতে হয় রান্নাবান্না ও ঘরগৃহস্থালির কাজ। সকল দুর্যোগে গৃহস্থালির যাবতীয় সামাল দিতে হয় নারীকে।
এদিকে জনপ্রশাসন, সেবা ও পরিষেবা খাতের কর্মজীবী নারী সরকারী বেসরকারী অফিসে, ব্যাংক বীমায় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ঘরে ফিরেই রান্নাবান্না শিশু পরিচর্যা এবং গৃহস্থালির সকল কাজই করেন। বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, নারী পুরুষের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি কাজ করে। ঘরে বাড়তি এই কাজের জন্য নারী কোন বেতন বা মজুরি পায় না। ধরেই নেয়া হয় বাইরের কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজ নারীর জন্য অদৃশ্য ‘ম্যান্ডেটরি’। একজন কর্মজীবী নারী অর্থের বিনিময়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় আট ঘণ্টা কাজের পর ঘরে ফিরে দৈনিক গড়ে ৩ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট গৃহস্থালি কাজ করে। আর পুরুষরা ঘরের কাজ করে মাত্র গড়ে ১ ঘণ্টা ১৪ মিনিট। মোট দেশীয় উৎপাদনে (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট জিডিপি) নানাভাবে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। সন্তান লালন-পালন এবং গৃহস্থালি কাজকর্মের স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। নারীর এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমান নির্ধারিত হয়নি। মহানগরী, নগর ও শহরে স্থায়ী ও অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে প্রায় পনেরো লাখ নারী। তারা দিন হাজিরায় মজুরি পায়। কখনও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায় বাসা বাড়িতে। এদের কাজ গৃহস্থালি। বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে গ্রামে ও শহরে গৃহস্থালি কাজ করেন প্রায় সোয়া কোটি মানুষ যার সিংহভাগই নারী। দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিনে দিনে বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে নারীর অবদান বাড়ছে।