ইউক্রেনে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজ রাশিয়ার রকেট হামলা,নিহত ১ ॥ নাবিকদের নেয়া হচ্ছে বাঙ্কারে ॥ পোল্যান্ডের দূতাবাসের মাধ্যমে সরানোর চেষ্টা ॥ নিহত আরিফের লাশ জাহাজের ফ্রিজে

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দর জলসীমায় আটকে পড়া বাংলাদেশী জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে অবস্থান করা ২৮ নাবিক ও ক্রুদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ বাধার পর আটকে পড়া ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের ক্যাপ্টেন, নাবিক ও ক্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস। তাদের নিকটবর্তী ব্যাঙ্কারে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পোলান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের সরানোর চেষ্টা চলছে। বুধবারে আটকে থাকা বাংলাদেশী জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধিতে রাশিয়ার রকেট হামলায় নিহত হয়েছে প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফ। তার মরদেহ জাহাজের ফ্রিজে রাখা হয়েছে। নাবিকের মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকার রুশ দূতাবাস। বৃহস্পতিবার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইউক্রেনে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান মিসাইল হামলায় নিহত হয়েছেন। আমরা নিহত নাবিকের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি।
এদিকে বুধবার রাশিয়ার রকেট হামলায় বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হওয়ার পর যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের জীবন বাঁচানোর আকুতি জানানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশী জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধিতে নাবিকরা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, রকেট হামলায় একজনের মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের নাবিক ও ক্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ফলে তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার অনিশ্চয়তা কাটছে বলে জানিয়েছেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি তৌহিদ ইমাম। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি তৌহিদ ইমাম জানিয়েছেন, বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা সবাই ভাল আছেন। অলিভিয়া পোর্ট থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ টাগবোটের মাধ্যমে ২৮ নাবিক ক্রুকে নিরাপদে জেটিতে সরিয়ে নেবে। এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে অবস্থান করা ২৮ নাবিক ক্রুদের জাহাজ চলাচল ও নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। যুদ্ধের শুরুতে এ নিয়ে সবাই আতঙ্কে ও অন্ধকারে থাকলেও খুব শীঘ্রই ভাল খবর আসতে শুরু করে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (শিপ পার্সোনেল) ক্যাপ্টেন আমির মোঃ আবু সুফিয়ান বলেছেন, বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ২৮ নাবিক ক্রুদের জেটিতে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পোল্যান্ড এ্যাম্বেসির কনফার্মেশন পেতে চাই। তারা আমাদের নাবিক ক্রুদের সেফটি-সিকিউরিটি নিশ্চিত করবে। জেটিতে আনার পর বন্দরের গেট পার হয়ে বাসে করে মলদোভিয়া নিয়ে যাবে। সেখানে বাঙ্কার আছে। সেখানে থাকতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতি, তাই এ পরিকল্পনায় ব্যাঘাতও ঘটতে পারে। এ জন্য আমরা তাদের পরিবারকেও জানিয়ে দিয়েছি, যেকোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিও ঘটতে পারে। ল্যান্ডে পদে পদে ঝুঁকি আছে। ইউক্রেনে সন্ধ্যার পরে সব বন্ধ হয়ে যায়। তাই কোন কারণে তাদের সরিয়ে আনার বিলম্ব ঘটলে টাগবোটের মাধ্যমে জাহাজ থেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিএসসি কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের চীফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক তুহিনের বাবা আবুল কাশেম ও মেজ ভাই মোঃ ওমর শরীফ। এ সময় বিএসসির মহাব্যবস্থাপক আমির মোঃ আবু সুফিয়ান তাদের বলেন, আপনাদের সন্তানের মাধ্যমে জাহাজের সবাইকে জানিয়ে দেন, তারা যেন জাহাজ থেকে লাইফবোট নিয়ে লাফ না দেয়। এটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মানতে বলেন। টাগবোট এলে তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হবে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন এমভি বাংলার সমৃদ্ধির চীফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক তুহিন বৃহস্পতিবার বলেছেন, যেকোন সময় এখানে আবারও মিসাইল পড়তে পারে। আমাদের লাইফ থ্রেটের মধ্যে আছে। বুধবার সন্ধ্যায় জাহাজের ব্রিজে একটি রকেট এসে পড়লে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। জাহাজে থাকা কর্মীরা আগুন নেভাতে পারলেও প্রাণ যায় থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের। ওমর ফারুক তুহিন বলেন, আমরা এখনও শিপে অবস্থান করছি। আমাদের শিপ থেকে নামানোর কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। কাইন্ডলি এটা প্রচার করেন।
বিএসসির মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেছেন, ওই জাহাজে থাকা ২৯ জনের মধ্যে বাকি ২৮ জন সুস্থ আছেন। তাদের মধ্যে দুজন নারী ক্যাডেটও আছেন। নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জাহাজের সঙ্গে। তাদের পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আপাতত জাহাজে থেকে যাওয়াই নিরাপদ বলে মনে হয়েছে।
জাহাজ সমৃদ্ধির মালিকানা বিএসসির হলেও ডেনিশ কোম্পানি ডেল্টা কর্পোরেশনের অধীনে সেটি ভাড়ায় চলছিল। গত ২৬ জানুয়ারি মুম্বাই বন্দর থেকে রওনা হয়ে তুরস্কের ইরেগলি হয়ে ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে পৌঁছায় জাহাজটি। ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি বন্দরের আউটার এ্যাঙ্করেজে ছিল, পরদিন ইনার এ্যাঙ্করেজে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বন্দর থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল বাংলার সমৃদ্ধির। কিন্তু সেদিন ভোরে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যায়। জাহাজটি যেখানে নোঙ্গর করে আছে সেখান থেকে মূল সাগরে যেতে ৬০ নটিক্যাল মাইল পথ পার হতে হবে এবং সেজন্য স্থানীয় পাইলট দরকার, যে পথ দেখিয়ে জাহাজটিকে বের করে নেবে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তা পাওয়া যাচ্ছে না।
মোটামুটি ৪০ দিন টিকে থাকার মতো খাবার ও পানি মজুদ আছে জাহাজে, রেশন করে চালালে আরও কিছু দিন চালানো যাবে। সে বিষয়ে আপাতত দুশ্চিন্তা না থাকলেও চোখের সামনে সহকর্মীর মৃত্যু দেখে নাবিকদের দেশে ফেরা নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে পৌঁছায়। ওই দিনই দেশটিতে রাশিয়ার হামলা শুরু হলে বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে জাহাজে আটকা পড়েন ক্যাপ্টেন জি এম নুরুই আলম, চীফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুকসহ ২৯ বাংলাদেশী নাবিক। ইউক্রেনে হামলা শুরুর সপ্তম দিনে বাংলাদেশী জাহাজটিতে গোলার আঘাত হয়। সমুদ্রগামী জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি ২০১৮ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়।
ইউক্রেন থেকে ফোন করেছিলেন আরিফ : নিহত প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফের বাবা আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, আমার ছেলে তো আর নেই। আমাদের বাঁচার অবলম্বনটুকু চলে গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রী ও মমতাময়ী মা শেখ হাসিনার কাছে আমার ছেলের লাশটা ফেরত আনার ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাই।
বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা : ইউক্রেনে বাংলাদেশী জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধিতে রকেট হামলায় নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের মা আমেনা বেগম। কথা বলতেই তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
বলতে গিয়েও কিছুই বলতে পারছে না। স্মৃতি হিসেবে ছেলের কয়েকটি মেডেল হাতে নিয়ে হাউমাউ করে কান্না করেছেন আর বলেছেন, ‘আমার ছেলের লাশটা তোরা আইন্না দে। আমার ছেলের লাশটা তোরা আইন্না দে। আমি তারে একটু দেখব’।
সর্বশেষ আরিফের যোগাযোগ হয় : আরিফ সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বুধবার বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। জানিয়েছিলেন, আটকে থাকা জাহাজ ছাড়া পেলে শীঘ্রই বাড়ি ফিরবেন। আরিফ বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে ছিল মেজো। দেশে ফিরলেই বাড়ির কাজে হাত দেয়ার পরিকল্পনা ছিল, স্বপ্ন ছিল পরিবারের জন্য আরও অনেক কিছু করার; সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন হাদিসুর রহমান। বুধবারও এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল মায়ের সঙ্গে, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান এখন ফিরবেন কফিনবন্দী হয়ে।
ভাঙ্গা ঘরে থাকতে হবে না : ছোট ভাই গোলাম রহমান তারেক জানান, বুধবারও ফোনে ইউক্রেনে বোমা, গুলির শব্দ ও যুদ্ধের অবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ভীতিকর পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন হাদিসুর। বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তার কথায়। ফোনে ভাই বলেছিল, আমাদের আর ভাঙ্গা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসেই যেভাবে হোক ঘরের কাজ ধরবে, বলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ছাত্র তারেক।
কথা বলার সময়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় : আরিফের স্বজনরা জানান, আট বছর ধরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন জাহাজে চাকরি করছিলেন তিনি। বুধবার জাহাজ থেকে ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সকে ফোন করেন তিনি। প্রিন্সের সঙ্গে কথা বলার সময় হাদিসুরের প্রান্তে বিকট শব্দ হয়। সে সময় আরিফের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে জানা যায়, রাশিয়ার রকেট হামলায় তার ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে।
বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না আরিফের : মা আমেনা বেগম বিলাপ করে বলছেন, ‘বাজানে মোরে কইছে, এইবার বাড়িতে আইয়া ঘর উডাইবে। আর আমাগো ভাঙা ঘরে থাহন লাগবে না। ঘরহান উডান অইলে বিয়া কইরা বউ ঘরে আনবে। মোর পোলাডার লাশটা আইন্না দ্যান। মোর পোলাডারে মুই এক নজর দেকমু, আর কিচ্ছু চাই না।’ বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা নিহতের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছি। যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা দেশের বাইরে। তাই তার লাশ ফেরত আনার বিষয়ে যে প্রক্রিয়া সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
ভিডিও বার্তায় আকুতি : ইউক্রেন অলিভিয়া বন্দরে আটকা পড়েছে বাংলাদেশী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’। গত ২ মার্চ জাহাজটিতে রকেট হামলায় এক বাংলাদেশী নাবিক নিহত হয়েছেন। বাকিরা আপাতত প্রাণে রক্ষা পেলেও তারা জাহাজেই আটকা রয়েছেন এবং তাদের অনেকেই ভিডিও বার্তা দিয়ে উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছেন। উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে আটকে পড়া নাবিকদের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে একজনকে কান্নাজড়িত কণ্ঠেও কথা বলতে দেখা যায়। ২৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের একজন নাবিক বলেন, ‘আমি বাংলার সমৃদ্ধির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের জাহাজে একটু আগে রকেট হামলা হয়েছে। একজন অলরেডি ডেড (মারা গেছেন)। আমাদের পাওয়ার সাপ্লাই নাই। ইমার্জেন্সি জেনারেটরে পাওয়ার সাপ্লাই চলছে। আমাদের বাঁচান।’
অপর ভিডিওতে ক্যাডেট তুলি নামে একজন বলেন, ‘আমি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজ থেকে বলছি। জাহাজে কিছুক্ষণ আগে বোম্বিং (বোমা হামলা) হয়েছে। আমাদের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার স্যার অলরেডি মারা গেছেন। আমরা সবাই খুব বিপদে আছি। আমাদেরকে উদ্ধার করেন এখান থেকে। আমাদেরকে বাঁচান প্লিজ।’
জাহাজের নাবিকদের বাঙ্কারে নেয়া হবে : চলমান সঙ্কটে ইউক্রেনে রকেট হামলার শিকার বাংলাদেশী জাহাজে থাকা নাবিকদের পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে নিকটবর্তী কোন বাঙ্কারে নিয়ে যাওয়া হবে। গণমাধ্যমকে এমনটি জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মহাব্যবস্থাপক (শিপ পার্সোন্যাল) ক্যাপ্টেন আমীর মোঃ আবু সুফিয়ান।
তিনি জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রেডক্রস বা অন্য কোন সংস্থার জরুরী পরিবহনের মাধ্যমে তাদের জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হবে। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএসসি মহাব্যবস্থাপক বলেন, আমাদের পোল্যান্ড এ্যাম্বাসি কাজ করতেছে। নিকটবর্তী কোন বাঙ্কারে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ধীরে ধীরে বর্ডার পাস করার চেষ্টা করা হবে। এখন বলতে পারি, জাহাজ থেকে বের করে তাদের জেটিতে নেয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ল্যান্ডে নেয়ার পরিবহন কনফার্ম করতে পারলে আমরা নাবিকদের নামিয়ে ফেলব। লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়া ডিফিকাল্ট। তাদের জেটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। এখন পোল্যান্ড দূতাবাসের মাধ্যমে বাকি কাজ করা হবে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মোঃ মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা দুপুর ১২টার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের শিপিং কর্পোরেশনের মতামত ও জাহাজ থেকে নাবিকদের নিরাপদে নামিয়ে নেয়ার বিষয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছি। এখন পোল্যান্ড দূতাবাস দেখবে।
জাহাজের ফ্রিজে নিহতের মরদেহ : বাংলাদেশের জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’তে হামলায় নিহত ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাদিসুর রহমান আরিফের (২৯) দেহাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে জাহাজের ফ্রিজেই। হামলায় তার দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মোঃ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, হাদিসুরের মরদেহ জাহাজের ফ্রিজেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। অনেকটা সরাসরি তার ওপর হামলা হয়েছে বিধায় তার দেহ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাহাজে বাকি ২৮ নাবিক অক্ষত আছেন। আমরা তাদের কিভাবে নিরাপদে আনা যায়, বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছি।
ঢাকার রুশ দূতাবাসের সমবেদনা : মিসাইল হামলায় নিহত বাংলাদেশী নাবিক হাদিসুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকার রুশ দূতাবাস। বৃহস্পতিবার এ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান মিসাইল হামলায় নিহত হয়েছেন। আমরা নিহত নাবিকের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। বন্দর থেকে বাংলাদেশী জাহাজের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিতে রাশিয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রাশিয়ান ফেডারেশনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ডাটা পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে বলেছে, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পিছু হটার সময় নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে জিম্মিদের ধরে নিয়ে যায়, তাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এটা সন্ত্রাসীদের কৌশল হিসেবেও সুপরিচিত।
দূতাবাস জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান থেকে উদ্ভূত মানবিক সমস্যা সমাধানে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার অনুরোধে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হটলাইন চালু করেছে। হটলাইন নম্বর +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৩৪-৪৬, +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৪২-১১ ও +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৪৭-০৯। এছাড়া ইমেলে (gumvs@mil.ru) যোগাযোগেরও অনুরোধ করা হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনারা বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানের কারণে বাংলার সমৃদ্ধি নামে বাংলাদেশী জাহাজটি ইউক্রেনে আটকে পড়ে। ওই জাহাজে স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে হামলা হয়। এতে জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাদিসুর রহমান মারা যান।
নৌ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য : বাংলার সমৃদ্ধির ওপর রকেট হামলা এবং এটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি জানান, জাহাজটির জীবিত ২৮ নাবিককে ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। তিনি বলেন, বুধবার রাত ১১টার দিকে ওই জাহাজে থাকা নাবিকরা ফোন করে বিষয়টি আমাদের অবহিত করে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলার সমৃদ্ধিকে টার্গেট করেই হামলা করা হয়েছে। নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নির্ভর করছে সে দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর। জাহাজের নাবিকরা তাদের উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। এদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বার্তায় শোনা যায়, ‘আমাদের বাঁচান, কোন জায়গা থেকে এখনও সাহায্য আসেনি।’
বিএসসির বক্তব্য : বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পীযুষ দত্ত বৃহস্পতিবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউক্রেনে আটকে পড়া জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধির বেঁচে যাওয়া সব নাবিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনাই তাদের মূল লক্ষ্য। এ ব্যাপারে নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ডিজি শিপিংসহ তৎপরতা চালাচ্ছে। সাংবাদিকদর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে পীযুষ দত্ত বলেন, বাংলার সমৃদ্ধিতে রকেট হামলা ও অগ্নিকা-ের ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া ২৮ নাবিকদের নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জাহাজটি ইউক্রেনে পাঠানো প্রসঙ্গে পীযুষ দত্ত জানান, এটিকে না পাঠানোর কোন সুযোগ ছিল না। চার্টারার যদি নিয়ে যেতে চায় আইনগতভাবে না পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। জাহাজের ক্যাপ্টেনের তৎপরতা নিয়ে বিএসসি সন্তুষ্ট বলে তিনি জানান। তারা জীবনবাজি রেখে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, জীবিত ২৮ নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে নিতে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেলে বিএসসি অনুমতি দেবে।
বেঁচে যাওয়া ক্যাপ্টেনসহ ২৮ নাবিকের তালিকা : বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মোঃ আনাম চৌধুরী জানান, বাংলার সমৃদ্ধিতে মূল নাবিকের সংখ্যা ছিল ২৯। থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাদিসুর রহমান রকেট হামলা নিহত হওয়ার পর অবশিষ্ট ২৮ জন হচ্ছেনÑ জিএম নুর ই আলম (ক্যাপ্টেন), মোঃ মুনসুরুল আমিন খান (এডিশনাল ক্যাপ্টেন), সেলিম মিয়া, রামাকৃষ্ণ বিশ^াস (সেকে- অফিসার), মোঃ রোকনুজ্জামান রাজিব (থার্ড অফিসার), ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি (ডেক ক্যাডেট-১), ফয়সাল আহমদ সেতু (ডেক ক্যাডেট-২), মোঃ ওমর ফারুক (চীফ ইঞ্জিনিয়ার), সাইয়েদ আশিকুল ইসলাম (এডিশনাল চীফ ইঞ্জিনিয়ার), রবিউল আউয়াল (সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার), সালমান সরওয়ার সামি (ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার), ফারজানা ইসলাম মৌ (ইঞ্জিন ক্যাডেট-১), মোঃ শেখ সাদি (ইঞ্জিন ক্যাডেট-২), মোঃ মাসুদুর রহমান (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার), মোঃ জামাল হোসাইন (বোসান অর্থাৎ সারেং), মোঃ হানিফ (খালাসি-১), মোঃ আমিনুর ইসলাম (খালাসি-২), মোঃ মহিউদ্দিন (খালাসি-৩), হোসাইন মোঃ রাকিব (সাধারন নাবিক-১), সাজ্জাদ ইবনে আলম (সাধারণ নাবিক-২), নাজমুল উদ্দিন (ফিটার), মোঃ নজরুল ইসলাম (ইলেক্ট্রেশিয়ান), সরোয়ার হোসাইন (অয়েলার-১), মোঃ মাসুম বিল্লাহ (অয়েলার-২), মোঃ হোসাইন (অয়েলার-৩), মোঃ শফিকুর রহমান (চীফ কুক), মোঃ আতিকুর রহমান (ফায়ারম্যান) ও মোঃ সাইফ উদ্দিন (জেনারেল স্টুয়ার্ড)।