কয়েকটি বড় শহর ও বন্দর রুশ নিয়ন্ত্রণে ॥ ওডেসার দিকে ধেয়ে আসছে রসদে ঠাসা রণতরী

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নির্ধারিত সময়ের আগেই ইউক্রেন দখলের ছক রাশিয়ার। বৃহস্পতিবার যুদ্ধের অষ্টম দিন পর্যন্ত রুশ সৈন্যরা দেশটির কয়েকটি বড় শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে হামলার তীব্রতা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে পুতিন বাহিনী। বৃহস্পতিবারও শহরটিতে দফায় দফায় হামলা হয়। নির্ধারিত ১৫ দিনের আগেই কিয়েভ দখলে এবার জলপথে হামলার প্রস্তুতি ক্রেমলিনের। এ লক্ষ্যে বুধবারই রাশিয়ার কয়েকটি রণতরী ইউক্রেনের দিকে যাত্রা করে। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, রসদে ঠাঁসা এসব রণতরী ক্রিমিয়া হয়ে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে হামলা চালাবে। ওডেসা ইউক্রেন অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। পরের টার্গেট মারিউপল ও কিয়েভ। মার্কিন এই গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ে ওডেসার মেয়র গেন্নাদি তুখানভ বৃহস্পতিবার বলেন, রুশ হামলার জবাব দিতে আমরাও প্রস্তুত। শহর রক্ষায় জনগণ বদ্ধপরিকর।
এদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বুধবার ইউক্রেন থেকে অবিলম্বে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সাধারণ পরিষদে দুুদিনেরও বেশি সময় ধরে বিতর্ক শেষে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরিষদের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের ১৪১ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ৩৫ দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়ায় রাশিয়াসহ পাঁচ দেশ। মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও ভোটদানে বিরত ছিল। ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও বেলারুশ প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়ায়। এ সময় ইউক্রেন রাষ্ট্রদূত মস্কোর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, বিশ্ব রাশিয়ার মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়ের জন্য রাশিয়া দায়ী। প্রস্তাবে কঠোর ভাষায় ইউক্রেনে রুশ হামলার সমালোচনা এবং একইসঙ্গে পরমাণু শক্তিকে সতর্কাবস্থায় রাখার পুতিনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়। জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ৫১ অনুযায়ী মস্কো আত্মরক্ষার কথা বলে। কিন্তু পশ্চিমাবিশ্ব মস্কোর এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, রাশিয়া জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ২ লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাধারণ পরিষদের এ প্রস্তাব কঠোর ও স্পষ্ট। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, কিছু বিদেশী নেতা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি। তবে মস্কো একেবারে ‘শেষ’ পর্যন্ত ইউক্রেনে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখবে। কারণ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অধিকার আছে। বৃহস্পতিবার মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের কোন চিন্তা নেই রাশিয়ার। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের এক সপ্তাহ পর রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাতকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে একজন ‘জাতিগত ইহুদি’ এবং ‘তিনি এমন একটি সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেখানে নাৎসিবাদ লালন করা হয়’ বলে অভিযোগ করেন ল্যাভরভ। তিনি বলেন, ইউক্রেন সঙ্কটের একটি সমাধান পাওয়া যাবে এবং এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। ইউক্রেনীয় এবং রুশ কর্মকর্তাদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনা অবশ্যই পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে হতে হবে বলে জানান এ শীর্ষ রুশ কূটনীতিক। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখার অভিযোগ করেন তিনি। এরপর বলেন, প্রচণ্ড সদিচ্ছা থাকলেও কাউকে নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন্ন করতে দিতে পারে না রাশিয়া।
ওদিকে বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, রুশদের বিরুদ্ধে তার দেশের সৈন্যরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। বুধবার মধ্যরাত থেকে শহরগুলোর ওপর বিরামহীনভাবে রুশ গোলাবর্ষণ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। পুতিনকে উদ্দেশ্য করে জেলেনস্কি বলেন, আপনার নিজের বাড়িতে ফিরে যান। জেলেনস্কি বলেন, পুতিনের রুশভাষী জনগণের জন্য লড়া উচিত, পুরো বিশ্বের জন্য নয়।
ইউক্রেনে রুশ হামলা নিয়ে মঙ্গলবার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বক্তব্যে ভøাদিমির পুতিনকে নিয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাইডেন বলেন, পুতিন একজন স্বৈরশাসক। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা পাঠানোর জন্য তিনি এখন একঘরে। এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও ধ্বংসাত্মক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে, যা দেশটির অর্থনৈতিক শক্তি শুষে নেবে এবং সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলবে। ইউক্রেন হামলার নির্দেশ দেয়া পুতিনের সমালোচনায় বাইডেন আরও বলেন, রাশিয়ার একজন স্বৈরশাসক আরেকটি দেশে হামলা চালাচ্ছেন যার মূল্য দিতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে।
ইউক্রেনে হামলার ফলে রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। এ বিষয়ে মস্কো সাফ বলে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কখনোই রাশিয়াকে টলানো যাবে না। ক্রেমলিন বলেছে, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে এখন মুখোমুখি আলোচনা শুরু হয়েছে তাই উভয় দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে আপাতত বৈঠকের সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেনে সাধারণ জনগণকে লক্ষ্য করে গুচ্ছবোমা ও ভ্যাকুয়াম বোমা নিক্ষেপের অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা বলে খারিজ করেছে রাশিয়া। রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের সম্পদ জব্দ করেছে।
খেরসনে যেসব নিয়ম জারি করল রাশিয়া : ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর খেরসনের নিয়ন্ত্রণ এখন রাশিয়ার হাতে। খেরসনের একজন বাসিন্দা বলেছেন, শহরটিতে রাশিয়া নতুন নিয়ম জারি করেছে। বৃহস্পতিবার নিনা নামে একজন নারী বলেন, আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছে। আমাদের স্থানীয় সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার সেনাদের চুক্তি হয়েছে এই শহরের কেউ রাশিয়ার সেনাদের ওপর হামলা করবে না এবং তাদের উত্তেজিত করবে না। তাছাড়া আমরা দলবদ্ধ হয়ে চলতে পারব না। দ্রুত গাড়ি চালাতে পারব না। রুশ সেনারা গাড়িতে তল্লাশির সময় তাদের উত্তেজিত করা যাবে না। নিনা আরও বলেন, এখন শহর অনেক শান্ত। কেউ বাসা থেকে বের হয়নি। কারণ এটি খুবই বিপজ্জনক।
রেডিও স্টেশন বন্ধ করল রাশিয়া : ইউক্রেনে নিজেদের সামরিক অভিযান নিয়ে ভুল তথ্য প্রচারের অভিযোগে একটি রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। সরকারী বয়ান অনুযায়ী সংবাদ প্রচার না করায় এমন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের যেকোনও বক্তব্যই বিপজ্জনক : মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে যেকোনও বক্তব্যই বিপজ্জনক। এক সাক্ষাতকারে তার কাছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমর্থনে কোন কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। এনবিসির লেস্টার হল্ট এর ওই প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে যেকোনও বক্তব্যই বিপজ্জনক আর আমি মনে করি আমাদের এগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত, সম্ভব হলে সবকিছু। বুধবার সম্প্রচারিত ওই সাক্ষাতকারে লয়েড অস্টিন আরও বলেন, ‘এতে পরিবেশ তৈরি হয়, এতে মারাত্মক ভুল হিসেবের শর্ত তৈরি হয় আর আমরা সেগুলো ঘটতে দেখতে চাই না।’
ইউক্রেনকে আরও ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে জার্মানি : জার্মানি ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র দিচ্ছে। দেশটি নতুন করে আরও ২,৭০০ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে। সরকারী সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, জার্মান সরকার যুদ্ধরত ইউক্রেনে আরও অস্ত্র সহায়তা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছে। সাবেক সোভিয়েত আমলের এই ক্ষেপণাস্ত্র এর আগে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি ব্যবহার করেছিল।