করোনার বিদায়ঘণ্টা, ভবিষ্যতে ফ্লুর মতো রোগে পরিণত হতে পারে

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ওমিক্রনেই শেষ হতে চলেছে অতিমারী করোনা। দেশেও করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার নিচে নামছে। প্রতিদিনই কমছে নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ওমিক্রনের প্রভাবেই করোনা চূড়ায় পৌঁছার পর নিচে নামতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণাকেই সত্যি প্রমাণ করে গোটা বিশ্বেই এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
আগামীতে করোনা থাকলেও হাল্কা ভাইরাসজনিত রোগে পরিণত হবে। যদি না আগামী তিন মাসের মধ্যে করোনার নতুন ধরনের রূপান্তর না ঘটে। বিশ্বে টিকাকরণের পরিধির প্রসারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া এবং করোনার সংক্রমণ ক্ষমতা কমে আসায় ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও বিশেষজ্ঞরা জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু এবং নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। এমনকি টিকা সনদ ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশনের অনুমোদনও দেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানই খুলে দেয়া হয়। তবে আজ বুধবার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে। সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ায় জনগণের মধ্যেও করোনা ভীতি কেটে গেছে। সরকারের টিকা কর্মসূচী জোরদারের কারণে করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ১২ কোটি ৪২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৫ জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে ৮ কোটি ৪৩ লাখ ২৬ হাজার ২৩৪ জনকে। এখন পর্যন্ত বুস্টার ডোজ পেয়েছেন ৩৮ লাখ ৩ হাজার ১৪৭ জন।
এর আগে সম্প্রতি ইউরোপের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ) বলেছিল, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনটি যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে করোনা মহামারী শেষ হতে চলেছে। তবে সাধারণ মানুষকে বারবার বুস্টার ডোজ দেয়ার মাধ্যমে মহামারী নিয়ন্ত্রণ টেকসই কোন কৌশল নয় বলেও সংস্থাটি মনে করে।
নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থাটির টিকা কৌশল বিভাগের প্রধান মারকো ক্যাভালেরি সাংবাদিকদের বলেন, করোনা মহামারী কবে শেষ হবে, তা আমরা কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে আমরা সেটা দেখতে পাব। তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ওমিক্রন সংক্রমণের কারণে প্রচুর প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে উঠছে। এখন করোনা মহামারী শেষের দিকে ধাবিত হবে। একই সঙ্গে ক্যাভালেরি সতর্ক করেছেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা এখনও মহামারীর মধ্যেই রয়েছি। এর আগে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসও ওমিক্রনকে মহামারী শেষের আভাস বলে দাবি করেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডাঃ মুসতাক হোসেন বলেছেন, অধিক হারে সংক্রমণের কারণে করোনার প্রকোপ এখন কমেছে। তবে করোনা মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা ঠিক হবে না। কারণ বৈশ্বিকভাবে ভাইরাসটি শেষ হয়ে যায়নি। টিকাকরণের পরিধি বাড়া এবং ওমিক্রনে অধিক হারে সংক্রমণের কারণে মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। মহামারী শেষ না হওয়ায় ফের নতুন ধরনের উৎপত্তি ঘটতে পারে। নতুন ধরন আসলে তিন মাসের মধ্যেই করোনা সংক্রমণ ফের বাড়তে পারে। আর যদি নতুন ধরন নাও আসে তবে তিনমাস পর ওমিক্রনের প্রভাবেও সংক্রমণ বাড়তে পারে। তাই মহামারী এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেটি বলার মতো প্রেক্ষাপট এখনও সৃষ্টি হয়নি। তবে জনগণকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মঙ্গলবার দেশে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭৯৯ জনের, ২৮ ফেব্রুয়ারি ৮৯৭ জন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ৮৬৪ জন, ২৬ ফেব্রুয়ারি ৭৫৭ জন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৪০৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৫১৬ জন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১২৯৮ জন, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৫৯৫ জন, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ জন, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ জন, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২১৫০ জন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২৫৮৪ জন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ৩৫৩৯ জন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ৩৯২৯ জন ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ৪৭৪৬ জনের।
আর মঙ্গলবার নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩.৩৫ শতাংশ। গত ১৪ দিনে নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ৪.০১ শতাংশ, ৪.১৫ শতাংশ, ৫.৪৮ শতাংশ, ৫.৫৩ শতাংশ, ৫.৫৮ শতাংশ, ৬.৭৭ শতাংশ, ৬.৭৭ শতাংশ, ৬.৯৪ শতাংশ, ৭.৮২ শতাংশ, ৮.৭১ শতাংশ, ৮.৭১ শতাংশ, ৯.৩১ শতাংশ, ১০.২৪ শতাংশ, ১২.২০ শতাংশ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি করোনা শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই করোনা শনাক্তের হার কমছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোন দেশে নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। গত চার দিনে দেশে করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
মঙ্গলবার করোনায় মারা গেছেন ৮ জন। আগের ১৪ দিনে যথাক্রমে মারা গেছেন ৮ জন, ৪ জন, ৯ জন, ৪ জন, ১১ জন, ১০ জন, ৫ জন, ১৬ জন, ৯ জন, ২১ জন, ১৩ জন, ২৪ জন, ২০ জন, ১৫ জন ও ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ মৃত্যুও প্রতিদিনই কমছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত। গত ২৯ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বির ভাইরোলজি ল্যাবে রাজধানীর ৪৮ জন করোনা রোগীর নমুনা পরীক্ষায় এ ফল পাওয়া গেছে।
আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, ৪৮টি নমুনার মধ্যে ৪৭টি নমুনায় ওমিক্রনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। বাকি একজনের নমুনায় পাওয়া গেছে ডেল্টা ধরন। শতকরা হিসাবে যা ২ শতাংশ। করোনা রোগীদের মধ্যে ওমিক্রনের বিএ.২ উপ-ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৩ শতাংশ রোগী। বাকি ১৭ ভাগ রোগী বিএ.১ উপ-ধরনে আক্রান্ত। অর্থাৎ এই গবেষণায় পর বলা যায়, তৃতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশে ওমিক্রনের প্রভাবেই করোনা আক্রান্ত বেশি হয়েছে। ফলে ওমিক্রনের প্রভাবেই দেশে বেশির ভাগের করোনা হয়েছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সেই হিসেবে ধরেই নেয়া যায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে ওমিক্রনেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। হার্ড ইমিউনিটির কারণে করোনা সংক্রমণ কমছে ধারণা করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্যবিদদের একাংশ এটির সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর ড. ডন মিল্টন বলেন, হার্ড ইমিউনিটি অধরা ধারণা এবং করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই ধারণা প্রযোজ্য নয়। তিনি বলেছেন, কোন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি অর্জন করে ফেললে অরক্ষিত মানুষের মধ্যে ছড়ানো কঠিন হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হামের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য কোন জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ মানুষকে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের প্রাথমিক প্রত্যাশা ফিকে হয়ে গেছে। প্রথমত, টিকা বা আক্রান্ত হওয়ায় যে ইমিউনিটি তৈরি হয় সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা কমে যাচ্ছে। যদিও টিকার কারণে রোগের ভয়াবহতা থেকে দৃঢ় সুরক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু এ্যান্টিবডি ম্রিয়মান হওয়ার ফলে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে- এমনকি বুস্টার ডোজ নেয়া মানুষেরও।
ড. ডন মিল্টন বলেন, মানুষ ‘হার্ড রেজিসট্যান্স’-এর দিকে এগোচ্ছে। যে অবস্থায় ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া অব্যাহত থাকলেও কিন্তু মানুষের পর্যাপ্ত সুরক্ষা থাকবে। এর ফলে ভবিষ্যত সংক্রমণ সমাজের জন্য এখনকার মতো ব্যাঘাতমূলক হবে না। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, কোভিড-১৯ ফ্লু’র মতো রোগে পরিণত হতে পারে এবং মৌসুমি সংক্রমণ ছড়াবে কিন্তু তা খুব ব্যাপক হবে না।
আপাতদৃষ্টিতে দেশের করোনা পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি নয়, হার্ড রেজিসট্যান্সের দিকেই এগোচ্ছে দেশ।