চার শহর রাশিয়ার দখলে ॥ ইউক্রেন প্রাণপণ লড়ছে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ চার শহরের দখল নিয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধের চতুর্থ দিন রবিবার রাজধানী কিয়েভের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যায় রুশ সৈন্য। অপরদিকে ইউক্রেন সেনাবাহিনী রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রাণপণ লড়াই করছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির সাধারণ জনতা হাতুড়ি, ছুরি ও অন্যান্য ছোট অস্ত্র হাতে রুশ বাহিনীকে রুখতে রাস্তায় নামে। এসব দলে বহু নারীও ছিলেন। রবিবার কিয়েভের পাশাপাশি ইউক্রেনের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর খারকিভে ঢুকে পড়ে রুশ সামরিক যান। এখানেও ইউক্রেন বাহিনীর প্রবল বাধার মুখে পড়ে রুশরা। রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়া ইউক্রেনের মারিয়াপোল, কাখোভকা, খেরশন ও বারদিয়ানস্ক থেকে হাজার হাজার লোক জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশীদেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। বরিবার পোলান্ড সীমান্তে ২৭ ঘণ্টার দীর্ঘ লাইন পড়ে। বহু মানুষ দীর্ঘ অপেক্ষার পর সীমান্ত অতিক্রম করে।
এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউক্রেন। রবিবার দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ হামলা বন্ধে এখনই পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করেন। একই দিন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। শনিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে ইউক্রেন নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব করেন। কিয়েভ কর্তৃপক্ষ প্রথমে প্রস্তাব মেনে নিলেও রবিবার তা প্রত্যাখ্যান করে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, আলোচনার স্থান নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। বেলারুশ যেহেতু রাশিয়ার ঘনিষ্ঠমিত্র তাই আমরা নিরপেক্ষ কোন দেশে বসতে চাই। আলোচনার জন্য ইউক্রেন ওয়ারস, ব্রাতিসলাভা, বুদাপেস্ট ও ইস্তানবুলের নাম উল্লেখ করে।
কাখোভকায় রুশ সৈন্য ঢুকে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ওই শহরের মেয়র ভলোদিমির কোভালেঙ্কো বলেন, রুশ সেনারা শহরের দখল নিয়ে সব ভবন থেকে ইউক্রেনের পতাকা নামিয়ে ফেলেছে। তিনি শহরের বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বের হবেন না। মস্কো দাবি করেছে, রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরোশেন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বারদিয়ানস্ক শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাশেঙ্কোভ বলেছেন, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় খেরোশেন ও বারদিয়ানস্ক শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এই হামলার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে তিনি গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য ‘অংশীদারদের’ ধন্যবাদ জানান। ওয়াশিংটন নতুন সামরিক সহায়তা হিসেবে কিয়েভকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বার্লিন বলেছে, কিয়েভকে তারা ১ হাজার এন্টি-ট্যাঙ্ক গোলা এবং ৫শ’ স্টিনজার মিসাইল সরবরাহ করবে। প্যারিস বলেছে, তারা আরও অস্ত্র সরবরাহ করবে।
আবাসিক এলাকায়ও হামলা হচ্ছে : রুশ বাহিনী ইউক্রেনের আবাসিক এলাকায়ও হামলা চালাচ্ছে বলে দেশটির প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন। রবিবার অনলাইনে পোস্ট করা এক বক্তব্যে তিনি বলেন, শনিবার রাত ছিল ভয়াবহ। আবাসিক এলাকা, বেসামরিক স্থাপনায় বারবার গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়েছে। তাই রুশ বাহিনীকে রুখতে সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সেনাবাহিনী। কিভাবে এ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আপনাদের কাছে অস্ত্র বা গোলাবারুদ থাকুক বা না থাকুক, সাধ্যমতো সব উপায় ব্যবহার করে লড়াই চালিয়ে যান। রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে রাখুন।
জেলেনস্কি-এরদোগান ফোনালাপ : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। শনিবার এরদোগান জেলেনস্কিকে ফোন দিয়ে যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তুর্কি প্রেসিডেন্টের যোগাযোগবিষয়ক অধিদফতর জানিয়েছে, রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের ভুক্তভোগী এবং নিহত নাগরিকদের প্রতি এরদোগান সমবেদনা প্রকাশ করেন। ইউক্রেনবাসী দ্রুত শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি। এরদোগান জেলেনস্কিকে বলেন, সম্পদ এবং প্রাণহানি রোধে দ্রুত যাতে ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করা হয়, তিনি সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলেনস্কি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, কৃষ্ণ সাগরে জাহাজ বন্ধ করা এই সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক এবং সামরিক সহায়তার জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ফের ধন্যবাদ জানান। তুরস্কের সহায়তার কথা ইউক্রেনের জনগণ কখনও ভুলবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে চলতি সপ্তাহেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে টেলিফোন করেন। ওই সময় তিনি ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে রাশিয়ার স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে কথা বলেন।
দেশ ছেড়েছে পাঁচ লাখ ইউক্রেনীয় : ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। ভিনদেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছে তারা। রবিবার জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এ তথ্য জানায়। শনিবারও কিয়েভে তুমুল লড়াই হয়। যুদ্ধের তৃতীয় দিন রুশ বাহিনী শহরটির কেন্দ্রস্থলে ঢোকার চেষ্টা করে। ইউক্রেন সেনারা রুশদের প্রতিহত করতে প্রাণপণ লড়াই করে। তারপরও কিয়েভে রুশ ট্যাঙ্ক দাপিয়ে বেড়ায়। এ সময় কয়েকজন ইউক্রেনীয় লালপতাকা নেড়ে রুশ বাহিনীকে স্বাগত জানায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কিয়েভের ওপর রুশ হামলার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত তা শোনা যায়। এ অবস্থায় ভলোদিমির জেলেনস্কি কিয়েভে হামলা প্রতিহত করার অঙ্গীকার করেন। তিনি ইউক্রেনীয়দের সতর্ক করে বলেন, তারা কোন অবস্থাতেই রাজধানীকে হারাতে পারবে না। এ অবস্থায় কয়েক হাজার জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় ইউক্রেন। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। তিন দিনের এই যুদ্ধে নারী ও শিশুসহ উভয় পক্ষে কয়েক শ’ সৈন্য নিহত হয়েছে। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র চেরনোবিল থেকে বিপজ্জনক গামা রশ্মির বিকিরণ বেড়েছে বলে ইউক্রেন দাবি করেছে। রুশ বাহিনী শুক্রবার চেরনোবিলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ওই এলাকায় গামারশ্মি বিকিরণের মাত্রা অন্তত ২০ গুণ বৃদ্ধির দাবি করেছে কিয়েভ।
সেই ১৩ সেনার জীবন উৎসর্গ করার খবর সঠিক নয় : রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের মুখে ভূখ-কে রক্ষা করতে গিয়ে দেশের ১৩ সেনার জীবন উৎসর্গের কথা জানিয়েছিল ইউক্রেন। দেশটি দাবি করেছিল, রুশ সামরিক বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়ে মৃত্যুুকেই বেছে নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু নতুন একটি তথ্য বলছে, আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানানোর পর রাশিয়ার বোমা হামলায় নিহত হওয়া নয়, ওই ১৩ সেনা হয়তো এখনও জীবিত থাকতে পারেন। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় বর্ডার গার্ড সার্ভিসের একটি ফেসবুক পোস্টে এই তথ্যই জানানো হয়েছে।
শনিবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয় ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় সীমান্তরক্ষী সংস্থা স্টেট বর্ডার গার্ড সার্ভিস অব ইউক্রেন (এসবিজিএসইউ)। সেখানে সংস্থাটি জানায়, ‘সমগ্র ইউক্রেনের মতো এসবিজিএসইউ এবং সামরিক বাহিনীও স্নেক আইল্যান্ডের সকল সেনা বেঁচে আছে বলে আশা করছে।