অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ জেলা-উপজেলায় সংস্কৃতি চর্চা বাড়ানোর আহ্বান

14
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ প্রান্তে যুক্ত হয়ে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করতে হবে সত্যি, কিন্তু বইয়ের পাতা উল্টে পড়ায় বেশি আনন্দ। তবে ভাষার গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে কেবল নিজের ভাষাকে গুরুত্ব দিলেই হবে না। অনুবাদ সাহিত্য যেন আরও ভাল হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের বাংলা সাহিত্য যেন অন্য ভাষাভাষীরা জানতে পারে, সেদিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি অন্য ভাষার সাহিত্যও আমাদের জানতে হবে।
জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত অমর একুশে বই মেলার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে বাংলা একাডেমি, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীতে দেশের প্রত্যেক জেলা বা মহুকুমায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সাহিত্য চর্চা হতো, সাহিত্য সম্মেলন হতো, আলোচনা হতো- যে চর্চাটা অনেকটা কমে গেছে। এটাকে আবার একটু চালু করা দরকার। আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব। বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে, সেটাই আমাদের অঙ্গীকার। মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলা একাডেমিতে যুক্ত হয়ে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বইমেলা দেরিতে শুরু করতে হলো। প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো। এ কারণে দেরি করে শুরু করতে হলো। আজকে উদ্বোধন করতে পারছি সেটাই বড় কথা। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু মেলাটা আরও সুন্দর হোক সেটাই চাই। এবারে মেলার মূল যে প্রতিপাদ্য এটা ভিন্নমাত্রা দিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি জেলার পাশাপাশি এখন উপজেলা পর্যায়েও শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এবং আমাদের এই বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও আপনারা যদি একটু উদ্যোগ নেন তাহলে আপনারা দেখবেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মেধাবী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি সেবী আমরা পাব। এতে করে তাদের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের যেমন সুযোগ আসবে, তেমনি মানুষের হৃদয়ের খোরাকটাওতো দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি এখন হৃদয়ের খোরাকটা জোগাতে হবে। আর তা সংস্কৃতি সেবীদের মধ্য থেকেই আসে। এজন্য মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জেলায় জেলায় করা উপযুক্ত হবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের উদ্যোগ নেয়া দরকার।
সরকারপ্রধান বলেন, সংস্কৃতি জগত বা আমাদের শিল্প সাহিত্য জগত বা এই ধরনের মেলা যদি হয় বা অনুষ্ঠানগুলো যদি হয় তাহলে কিন্তু আমাদের যারা যুব সমাজ রয়েছে তারাও ভিন্ন পথে যাবে না। তারা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতিও আন্তরিক থাকবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২১ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ১৫ জন বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কার বিজয়ী প্রত্যেকে ৩ লাখ টাকার চেক এবং ক্রেস্ট লাভ করেন।
বাংলা একাডেমির সভাপতি কথা-সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন সংস্কৃতি সচিব মোঃ আবুল মনসুর। আরও বক্তৃতা করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন। শুরুতে জাতীয় সঙ্গীতের পরই অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপরই ভাষা শাহীদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিটি নীরবতা পালন করেন।
অতীতে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এক মাসব্যাপী বই মেলার আয়োজন করা হলেও এবার করোনা পরিস্থিতির জন্য মেলা একটু দেরিতে শুরুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু আমরা এক মাসের জন্য করতাম কিন্তু আমরা এবার দেরিতে শুরু করেছি। আজকে ১৫ তারিখ। তাই এটা মনে হয় আমরা পুরো মাসই চালাতে পারি। যেহেতু আমাদের প্রকাশকদের পক্ষ থেকেও একটা দাবি এসেছে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত এটা চলতে পারে। আমি মনে করি যে, এই বই মেলাটা আমরা এক মাস চালাতে পারি। তবে সেটা আপনারা নিজেরাও ভেবে দেখবেন কারণ আমি একাতো আর কিছু বলতে পারব না। আর এই বই মেলাটাও শুধু বই মেলা নয়, সকলের মিলন মেলাও।
করোনার কারণে এবারের বই মেলায় আসতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষা জীবনে দিনভর বই মেলায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সেই স্কুল জীবন থেকে আমরা তো সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতাম আন্দোলন সংগ্রাম করতে। তারপর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাংলা একাডেমিতে যখন বইমেলা শুরু হলো, আমার তো মনে হয় যে কোন বইমেলা বাদ দিইনি। সারাদিন এই বই মেলায় ঘুরে বেড়ানো এটা তো আমাদের একটা অভ্যাসই ছিল।
আক্ষেপ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছি, তখনই পায়ে শেকল পড়ল। নিরাপত্তার অজুহাতে আর ওই বই মেলায় আগের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটা থাকেনি। আবার যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখন আবার গিয়েছি, তখন আবার সুযোগ ছিল। এখনতো সেই ২০০৯ সাল থেকে এই বন্দীদশায় আছি। আর করোনাকালীন আরও বেশি বন্দী হয়ে গেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি বলে আজ ভার্চুয়ালি হলেও সংযুক্ত হতে পেরেছি।
করোনাকালীন অনেক আপনজন এবং শ্রদ্ধাভাজনকে হারানোর দুঃখ প্রকাশ করে এই পরিস্থিতির অচিরেই উত্তরণ হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এখন যারা বই মেলায় আসবেন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলবেন। এটা একান্তভাবে দরকার। সরকারের টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা টিকা দিয়ে যাচ্ছি, বুস্টার ডোজও দেয়া হচ্ছে। যারা নেন নাই অবশ্যই তাদের টিকা এবং বুস্টার ডোজটা নিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, যাদের এখনও টিকা নেয়া হয়নি তারা সকলেই কিন্তু টিকাটা নেবেন। অন্তত টিকাটা নেয়া থাকলে আপনি একটু সুরক্ষিত থাকবেন। এই কথাটা সবাইকে একটু মনে রাখতে হবে। আর একটু মাস্কটা পড়ে থাকলেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা, কথা বলার অধিকার। এই ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। করাচি সাহিত্য সম্মেলনে ৪৭-এ ঘোষণা হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। তখনই প্রতিবাদ জানানো হয়। ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগ গড়ে তোলেন তিনি। অন্যান্য সংগঠন নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। সেই পথ বেয়ে ৫২-তে প্রাদেশিক পরিষদের সভা ছিল। বাজেট সেশনে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তটাও বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছিল। রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা আদায় করতে হয় আমাদের।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাণের মেলা। সেটা না হতে পারলে সবার মন খারাপ হয়। আমাদের ভাষার অধিকারে বারবার আঘাত এসেছে। আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা, রোমান হরফে বাংলা লেখার বিষয়টি এলো। বারবারই প্রতিবাদ করা হয়েছে। একটি জাতি সবসময় উন্নতি করতে পারে ভাষা সংস্কৃতির উন্নতি হলে। প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে সংস্কৃতিসেবীদের ভূমিকা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানকেও মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই ও তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা যে রিপোর্ট দিতো, সেগুলোতে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়।
শেখ হাসিনা বলেন, ভাষার জন্য রক্তদানের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগটিও পেয়েছি। এটা ধরে রাখতে হবে। অনেক আঘাত ও বাধা এসেছে। সব অতিক্রম করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির জনক বলতেন, জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জনের জন্যই ছিল আমাদের সংগ্রাম।
বিদেশী ভাষা-সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্ব আরও বড় করে তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশী ভাষা শেখায় আপত্তি নেই, বিদেশী ভাষাও শেখা দরকার। সেখানকার সংস্কৃতি চর্চাও জানা দরকার। কিন্তু নিজের যে অস্তিত্ব সেটাকে আরও বড় করে আমাদের দেখাতে হবে। আরও উন্নতমানের করতে হবে। আমাদের ভাষা সাহিত্য আরও ব্যাপক পরিচর্যা যাতে হয় তার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি অর্থাৎ অনলাইনে বাংলা ব্যবহারের জন্য আমরা নানা ধরনের বাংলা এ্যাপসও চালু করেছি।
অভিন্ন বাংলা ফন্ট ব্যবহারে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ফন্ট আছে সেটা একটা অভিন্ন ফন্ট যাতে ব্যবহার হয়, যাতে খুব সহজে সকলে কম্পিউটারের মাধ্যমে বা অনলাইনে ভাষা ব্যবহার করতে পারেন সেইভাবে একটা প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়ে গেছে। কাজেই ডিজিটাল প্রকাশনাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে করতে হবে। আধুনিক এই চর্চাটা যেন বাদ না যায় সেটা দেখার জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলকে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।