নিয়ন্ত্রণের বাইরে করোনা, সামনে কঠিন ২ সপ্তাহ ॥ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা ॥ সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বছরের শুরু থেকেই আবারও দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে শুরু করে করোনা সংক্রমণ। ২.৪৩ শতাংশ থেকে শুরু হওয়া সংক্রমণের হার শুক্রবার পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে। সংক্রমণের এই উর্ধগতি চলতি সপ্তাহেই ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের দৌরাত্ম্যে এই উর্ধমুখী সংক্রমণ চলমান থাকবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে এরপর থেকেই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নামতে শুরু করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই অন্তত আগামী দুই সপ্তাহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সহজলভ্য করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান তাদের। গত এক সপ্তাহের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের শুরুতে শনিবার পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ২৮.০২ শতাংশ। রবিবার তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.২৯ শতাংশে। সোমবার তা আরও বেড়ে শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৩২.৩৭ শতাংশ। তবে কিছুটা কমে মঙ্গলবার। এদিন শনাক্তের হার হয় ৩২.৪০ শতাংশ। কমতির দিকে থাকে বুধবারও। এদিনের শনাক্তের হার হয় ৩১.৬৪ শতাংশ। তবে বৃহস্পতিবার সংক্রমণ আবার ৩১.৯৮ শতাংশ হয়। তবে অনেক বাড়ে শুক্রবারে। এদিন শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৩৩.৩৭ শতাংশ। চলতি সপ্তাহে তা বাড়তে বাড়তে ৪০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছানোর আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) জানিয়েছে, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের অন্তত ৩টি উপধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে দেশে। আর এই উপধরনের মধ্যে বর্তমানে বিএ১ ধরনই বেশি জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, আমরা যতটা জেনেছি এর বিএ২ এবং বিএ৩ ধরনগুলো আরও সংক্রমণাত্মক। যদি এই দুটি উপধরন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরে তাহলে করোনার এই যে তৃতীয় ঢেউ চলছে তা আরও প্রলম্বিত হতে পারে। যা চলবে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে এ সময় সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে যদি কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা যায়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম যেমন মাস্ক, স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক স্প্রেগুলো সহজলভ্য করতে হবে। যদি সম্ভব হয় বিনামূল্যে সব জায়গায় মাস্ক বিতরণ করা। তবে তা অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে করতে হবে।
আইসিডিডিআরবি বলছে, ঢাকায় যে তিনটি উপধরন রয়েছে সেগুলো আফ্রিকা, ইউরো-আমেরিকান এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ওমিক্রন ধরনের সঙ্গে মিলেছে। জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে তাদের ল্যাবরেটরিতে ১ হাজার ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৮ শতাংশই ছিল করোনায় আক্রান্ত। আর আক্রান্তদের মধ্যে ওমিক্রন ছিল ৬৯ শতাংশের নমুনায়। ৬ ডিসেম্বর ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হওয়ার পরই আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পরীক্ষা করা ঢাকা শহরের ৭৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে পাঁচটিতে ওমিক্রন শনাক্ত করা হয়েছিল। অন্যগুলো ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। তাদের মধ্যে ওমিক্রনে আক্রান্ত ২৯ জনের মধ্যে ২৭ জনের মৃদু উপসর্গ কিংবা কোন উপসর্গও ছিল না।
এই যে উপসর্গ বোঝা যাচ্ছে না বা মারাত্মক কিছু হচ্ছে না তার কারণে অনেকের মধ্যেই একটা উদাসীন ভাব চলে এসেছে বলে মন্তব্য করে অপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টি বি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ আয়েশা আক্তার বলেন, শুরুতে মৃত্যুটা কম থাকলেও বুধবার পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ জনে। এটা স্বাভাবিক যে সংক্রমণের হার বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই। তবে যেহেতু ওমিক্রনটা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতো ভয়াবহ নয় কিন্তু অধিক হারে সংক্রমণ হলে জটিল রোগে যারা ভুগছেন তাদের অবস্থা তো খারাপ হবেই। আমরা যেমনটা দেখছি সম্প্রতি যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের জ্বর, কাশিসহ পাতলা পায়খানা হচ্ছে। আগে এসব উপসর্গ ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত থাকলেও বর্তমানে তা ৪ থেকে ৫ দিনের মতো স্থায়ী হচ্ছে। এটি কিছুটা ইতিবাচক হলেও যেহেতু সংক্রমণ বাড়ছে তাই সতর্কতার বিকল্প নেই। পরিবারের একজনের শরীরে হয়ত রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু যে আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছে তার অবস্থা তো খারাপ হবেই। সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণার বরাত দিয়ে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, সবচেয়ে বড় কথা আমরা দেখছি করোনা থেকে সুস্থ হয়ে গেলেও এর প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। এই যেমন আইইডিসিআর এক গবেষণা প্রেক্ষিতে বলছে, আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেলেও করোনার ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না। সুস্থ হয়ে ওঠার পরও অনেক মানুষই বিভিন্ন উপসর্গে ভোগেন। ভাইরাসটিতে সংক্রমণের ছয়মাস পরও ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনা পরবর্তী নানা উপসর্গ বিদ্যমান থাকছে। যা তিন মাস পর ৭৮ শতাংশ এবং এক বছর পরও থেকে যায় ৪৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে। আর উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিসসহ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের করোনা পরবর্তী উপসর্গের আশঙ্কা আরও দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি থাকে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতেই হবে। আক্রান্ত হলেও সুস্থ হয়ে যাব এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে মাস্ক, স্যানিটাইজার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলাফেরা করতে হবে। আর অতি অবশ্যই টিকা নিতে হবে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণের হার ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও করোনা গবেষক ডাঃ তুষার মাহমুদ। তিনি বলেন, বর্তমানে যে ৩১ বা ৩২ শতাংশ সংক্রমণের হারের কথা বলা হচ্ছে তা যদি যথাযথভাবে পরীক্ষা হয় তাহলে এমনিতেই বেশি হবে। আমরা যেমনটা দেখছি এক পরিবারের যদি ১ জনের উপসর্গ থাকে তাহলে সেই পরীক্ষা করায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পরিবারের সবারই। এক্ষেত্রে মূল শনাক্তের হার বাড়বেই। এখন যে উর্ধমুখী সংক্রমণ রয়েছে তা চলতি সপ্তাহেই বাড়ার আশঙ্কা করছি আমরা। ভাইরাসটির এখন পর্যন্ত আমরা যে গতিপ্রকৃতি দেখেছি তার হিসেব এখন তার ‘পিক’ সময় চলছে। আগামী দুই সপ্তাহ এরকমই থাকবে। তবে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কমতে শুরু করবে সংক্রমণ। কারণ এর মধ্যেই অধিকাংশ মানুষ আক্রান্তের মধ্যে চলে আসবে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আমরা আশা করতেই পারি।
এদিকে সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের সব হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ নিয়াতুজ্জামান বলেন, গত বছরের শেষের দিকে করোনা রোগী একেবারেই ছিল না বলতে গেলে। তাই আমরা এখানে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ জন করে ভর্তি হলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন ১শ’র মতো রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের এখানে সব মিলিয়ে দেড়শ’টি বিছানা এবং ৬০টি কেবিন প্রস্তুত আছে। যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে আবারও পুরোপুরি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত করা হবে পুরো হাসপাতালকে।
তবে যেহেতু ভাইরাসটি একেবারেই গতিপ্রকৃতি এখনও কোন চূড়ান্ত রূপ পায়নি তাই এটি কবে নাগাদ কমতির দিকে আসবে তা চিন্তা না করে স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, যে হারে আক্রান্ত বাড়ছে আমরাও আশঙ্কা করছি আগামী এক/দুই সপ্তাহের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। তবে মানুষজন যদি সতর্ক হয়। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ হবে না বলে আশা করছি। যেহেতু ওমিক্রনের ভয়াবহতা অনেকটা কম তাই আমাদের সদিচ্ছা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করবে।