আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া বন্ধ ॥ অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগে সাবেক ৫ শিক্ষার্থী আটক

11

স্টাফ রিপোর্টার :
জটিলতা নিরসনের কোন সুস্পষ্ট লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শাবির উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের অনশন চলছে। অসুস্থতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ক্রমশ ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় মেডিক্যাল সাপোর্ট বন্ধ রয়েছে। উপাচার্য নিজ বাস ভবনে অবরুদ্ধ রয়েছেন। মঙ্গলবারও শিক্ষার্থীদের বাধার কারণে ভিসিকে খাবার দিতে পারেননি শিক্ষকরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তার বাসভবন অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। সাংবাদিক ও পুলিশ ছাড়া আর কাউকেই তার বাসভবনে ঢুকতে দিচ্ছেন না তারা। ভিসির জন্য খাবার নিয়ে তার বাসভবনে প্রবেশ করতে আজও শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়েছেন শিক্ষকরা।
মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১টার দিকে শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাশ, সাধারণ সম্পাদক মহিবুল আলম, সহসভাপতি ড. আশরাফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য নিয়ে ভিসির বাসভবনে প্রবেশ করতে যান। তখন বাসভবনের সামনে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাধা দেন। তখন নিজেদের দাবি-দাওয়া আলোচনার টেবিলে বসে জানাতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান শিক্ষকবৃন্দ। তবে শিক্ষকদের কোন কথাই শুনতে রাজি হননি শিক্ষার্থীরা। এর আগে, গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় শাবির বেশ কয়েকজন শিক্ষক খাবার নিয়ে ভিসির বাসভবনে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়েন। তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গত রবিবার রাতে শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ নিয়ে সর্বত্র তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর প্রেক্ষিতে গতকাল রাতে পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়।
গণফোরামের সাংসদের সংহতি প্রকাশ : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন সিলেট-২ আসনের (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) সংসদ সদস্য ও গণফোরামের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান। মঙ্গলবার দুপুরে তিনি শাবি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দেখতে যান। এ সময় তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। এখানে কোন ধরনের রাজনীতি নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এগিয়ে আসেন সব সমস্যা সমাধানে। তিনি চাইলেই এই সমস্যা সমাধান করতে পারেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি শাবিপ্রবিতে আসেন। সেখানে তিনি আধাঘণ্টা অবস্থান করেন। এ সময় এমপি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থীদের কথা বলিয়ে দেন।
ফেনসিডিলের ঘটনায় তোলপাড় : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেনসিডিলসহ এক সিকিউরিটি গার্ডকে আটক করেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার রাত ১১টার দিকে ওই সিকিউরিটি গার্ডকে আটক করে শিক্ষার্থীরা। এরপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। জাহিদুর রহমান নামের যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত। শিক্ষার্থীদের হাতে ধৃত জাহিদুর রহমান জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাকে ওই পার্সেল আনতে গেটে পাঠিয়েছিলেন। ওই প্যাকেটের ভেতর কী ছিল সেটা আগে থেকে সে জানত না। ওই শিক্ষকের নাম কী- এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদুর কারও নাম জানাতে পারেনি। পরে গণমাধ্যমকর্মী, পুলিশ ও তিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে জাহিদুরকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষকের ছবি দেখালে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মাজহারুল ইসলাম মজুমদারকে শনাক্ত করে জাহিদ। সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেছেন, এক যুবক উপাচার্যের বাসভবনের দিকে ঢুকছিল। সে এখানকার আউট সোর্সিংয়ের সিকিউরিটি গার্ড। জাহিদুর রহমান নামে ওই সিকিউরিটি গার্ডকে ফেনসিডিলসহ শিক্ষার্থীরা আটক করে পুলিশের হাতে দিয়েছে। ওই গার্ড জানিয়েছে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের জন্য ফেনসিডিল আনতে গিয়েছিল। এই ঘটনায় নিরাপত্তাকর্মী জাহিদুর রহমান ও জুমান আহমদকে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেছে পুলিশ। জালালাবাদ থানার ওসি নাজমুল হুদা জানান মামলায় আপাতত দুজনকে আসামি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে যার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাকেই মামলার আসামি করা হবে। এদিকে আটকের পর জাহিদ বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগের অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম মজুমদারের জন্য সে ফেনসিডিল নিয়ে গিয়েছিল। ওই শিক্ষক উপাচার্য ভবনের পাশের গেস্ট হাউসেই অবস্থান করছেন। আমাকে ওই স্যার বলেছেন, তিনি অসুস্থ। তার ওষুধ প্রয়োজন। এরপর একজনের নাম আর মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছেন, তার কাছ থেকে এটি নিয়ে আসতে। তার কাছ থেকে একটি বক্স পান জাহিদ। তবে ভেতরে যে ফেনসিডিল ছিল সেটি তিনি জানতে না।
জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে অনলাইন ক্লাস চলাকালে শাবির এই শিক্ষকের ধূমপানের ছবি অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাচের অনলাইন ক্লাস চলাকালে ধূমপানরত অবস্থায় তার একাধিক ছবি প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। গণমাধ্যমের কাছে সে সময় তিনি সে ছবির সত্যতাও স্বীকার করেছিলেন।
চিকিৎসা সেবা বন্ধ : উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দলনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের টিম চিকিৎসা সাপোর্ট দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ৬টি এ্যাকাউন্টই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের একটি দল শাবিপ্রবিতে অনশনকারীদের চিকিৎসা সেবা দিতে শাবিপ্রবিতে আসেন। এরপর সোমবার থেকে তারা অনশনকারীদের কোন মেডিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছেন বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানায়। আন্দোলনকারীদের এক মুখপাত্র আরিফুল ইসলাম চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানায়, ‘অনশনরত শিক্ষার্থীদের সবার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। তারা সবাই খিঁচুনি, ব্লাডে অক্সিজেন ও সুগার লেভেল কমে যাওয়া, ব্লাড প্রেশারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় পড়ছেন। তারা অর্গান ড্যামেজের ঝুঁকিতে আছেন। কেন এই শিক্ষার্থীরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসেও মেডিক্যাল সাপোর্ট পাচ্ছেন না তা নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক মোঃ নাজমুল হাসান বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। এখন শিক্ষার্থীদের এবং আমাদের চিকিৎসকদের মধ্য থেকে কয়েকজনের করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় আমরা আপাতত সেবাটি বন্ধ রেখেছি। পরবর্তীতে আমরা কী করব, সেটা জানিয়ে দেব।
অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগে সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থী আটক : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগে ঢাকায় শাবিপ্রবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আটক পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের নাম পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান স্বপন, আর্কিটেকচার বিভাগের রেজা নূর মঈন দীপ ও নাজমুস সাকিব দ্বীপ। এর মধ্যে রেজাকে সোমবার সন্ধ্যায় উত্তরাস্থ তার বাসা থেকে বেরিয়ে মুদি দোকানে কেনাকাটার জন্য গিয়েছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তাকে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিট আটক করে।
অভিযোগ রয়েছে- শাবির উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রেজা ও হাবিব আর্থিক সহায়তা করছেন। আরও অনেক বন্ধুদের কাছে থেকে তারা টাকা সংগ্রহ করেও দিয়েছেন। একারণে তাদের আটক করা হয়েছে। সূত্র জানায়, শাবিপ্রবির আন্দোলনের নেপথ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের টাকার জোগান দেয়ার পেছনে আর কারা রয়েছেন সেসব বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য আটককৃতদের সিলেটে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের একটি অংশ অনশন ভাঙ্গতে চায় : উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলবে তবে আমরণ অনশন কর্মসূচী থেকে সরে আসতে উদ্যোগী হয়েছে অন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। অনশন কর্মসূচির অষ্টম দিনে এমন অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। একদল শিক্ষার্থী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে সমবেত হয়ে অনশনকারীদের অনশন ভাঙ্গার অনুরোধ জানান। এর আগে তারা, উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একাংশকে এই শপথ পড়ান মোহাইমিনুল বাশার রাজ। তবে অনশন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানও রয়েছে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশের। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে দুইপক্ষের মধ্যে। অনশনকারী শিক্ষার্থী শাহারিয়ার আবেদিন বলেন, ‘আমি আরও কিছুদিন না খেয়ে থাকতে পারব। আমি অনশন চালিয়ে যেতে চাই। আমি অনশন ভাঙ্গব না।’ আরেক অনশনকারী একই কথা বলেন। এদিকে, অনশন ভঙ্গে আন্দোলনকারীদের আরও কিছুটা সময় দিয়েছে সহযোদ্ধারা। আন্দোলনকারীরা জানান, অনশন ভাঙ্গলেও তারা দিন-রাতের পুরোটা সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করিয়ে তবেই স্থান ত্যাগ করবে।