বাঁধকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে সুনামগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায়

16

একে কুদরত পাশা সুনামগঞ্জ থেকে :
হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুতকরণ ও সকল বাঁধের কাজ অভিলম্বে শুরু করার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির। সোমবার সকালে দৈনিক সুনামকণ্ঠ সম্মেলন কক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব বখত বাহলুল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়। তারা সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
জেলা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হকি মিলন তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, পিআইসি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিটি উপজেলাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিলে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন দিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। শাল্লা উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধের প্রকল্প গ্রহণে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় বাহারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেছেন রফিনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর চৌধুরী। সব মিলিয়ে বাঁধকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির একটি মহোৎসব চলছে সুনামগঞ্জ জেলার প্রতিটি উপজেলায়।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মান কাজ ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের একমাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও বাঁধের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়নি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিকদের আচরণেও তা প্রত্যক্ষ হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েভ পোর্টালে পিআইসির তালিকা নেই। ১৯ জানুয়ারি সকালে আমাদের অনুরোধে তারা ওয়েভ পোর্টাল এ ৭টি উপজেলার পিআইসি তালিকা প্রকাশ করে। আজ পর্যন্ত শাল্লা, ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার পিআইসি তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। যেহেতু পিআইসি তালিকা প্রকাশ করা হয়নি সেহেতু কাজ শুরু করার কোন সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় দুশ্চিন্তায় দিন কাঠাচ্ছেন হাওরের কৃষকরা। আমরা হাওর বাঁচাও আন্দোলন দ্রুত বাঁধের কাজ শুরু করার জন্য দাবি জানাচ্ছি। আমরা এবার বলছি অনতি বিলম্ভে হাওরের বোর ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করতে হবে। যারা নীতিমালা অনুযায়ী শুরু করতে পারেনি তাদের বিরোদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। অন্যতায় হাওরে বিপর্যয় ঘটলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। আমরা হাওরের বিষয়ে এবার আইনের আশ্রয়নেবো। পরবর্তীতে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হবো।
এবার বাঁধের কাজে শুরু থেকেই একধরনের ঢিলেমি লক্ষ করা যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে গণশুনানি করে প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনের দাবি থাকলেও, সেটি করা হয় নি। তবে ব্যাতিক্রম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাবে পিআইসি গঠন করা হয়। এতে প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তাদের একটা যোগসাজশ থাকে। যে কারণে ওই ব্যক্তিরা কাজে গাফিলতি করেন।
তারা উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের নির্ধারিত সময়সীমা ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। জেলার ১১টি উপজেলায় এবার ৫২০ কিলোমিটারে ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত ও নির্মাণ হবে। এ পর্যন্ত ৭০১টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১১৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
জেলার ধর্মপাশা উপজেলায় ১৫৭টি, তাহিরপুর উপজেলায় ৬২টি, জামালগঞ্জে ৩৬টি, দিরাই উপজেলায় ৯০টি, শাল্লা উপজেলায় ১৩৮টি, শান্তিগঞ্জে ৫৫টি, জগন্নাথপুরে ২৮টি, সদর উপজেলায় ২৫টি, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৩৩টি, ছাতক উপজেলায় ১১টি, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৪১টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আমাদের উপজেলা কমিটি পরিদর্শণ করে দেখেছেন নামে মাত্র কয়েকটি বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে।
তারা অভিযোগ করেন, পাউবোর তথ্য এবং হাওরের বাস্তব চিত্রে কোন মিল নেই। ২০১৭ সালের মতো এবারও পাউবো কলম দিয়ে মাঠি কাঠতে চাইছে। তাই তারা মনগরা তথ্য সরবরাহ করছে। তাহিরপুর পাউবো সুত্রে জনায়, উপজেলার ৬ টি বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা ১৭ জানুয়ারি পরির্দশনে গিয়ে দেখা যায়, তাহিরপুর উপজেলার বর্ধিত গুরমার দক্ষিণ ও উত্তর এবং মাটিইয়ান হাওরের পাঁচ নাইল্লা, আলমখালি বাঁধের কাজ এখনও শুরু হয়নি। বর্ধিত গুরমায় ঐদিনই কাজ শুরু হয়। যে ৬ টি বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে বলা হয়েছিল আসলে বাস্থবে সে বাঁধগুলোতেও কাজ শুরু হয়নি। হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান এর নেতৃত্বে এ বাঁধগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। এ সময় সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সহসভাপতি মোদাচ্ছির আলম সুবল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফজলুল করিম সাঈদ উপস্থিত ছিলেন।
১৮ জানুয়ারি, হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় ও সুনামগঞ্জ জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক একে কুদরত পাশা ও সামছুল ইসলাম সরদার খেজুরের নেতৃত্বে দিরাই উপজেলা নেতৃবৃন্দ দিনভর উপজেলার চাপতি ও বরাম হাওরের বৈশাখি, কেজাউরা, তুফানখালীসহ বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন শেষে তাড়ল ইউনিয়নের ধল বাজার সংলগ্ন খেলার মাঠে বিকেলে কৃষক সমাবেশে মিলিত হলে স্থানীয় কৃষকরা তাদের হতাশা ও শঙ্কার কথা জানান।
পরিদর্শনকালে নোয়াখাল বাঁধে গিয়ে দেখা যায় গত বছরের বাঁধ অক্ষত রয়েছে, দু দিকে ৫০ ফুট করে নৌকা চলাচলের জন্য যে রাস্তা করা হয়েছিল তা খোলা আছে। অভিযোগ রয়েছে এ বাঁধেও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাড়ল ইউনিয়ন অংশে বৈশাখী বাঁধের কোন পিআইসিই কাজ শুরু করেনি। কাদিরপুরের ও একই অবস্থা অক্ষতবাঁধ থাকায় কাজ শুরু করেনি পিআইসি। তবে কৃষকরা দাবি করেছেন বাঁধ যেহেতু অক্ষত আছে তাই বাঁধের সামনের পিছনের গর্তগুলো বরাট করা জরুরী। দ্রুত কাজ শুরু করার দাবিবে তাড়ল ইউপি সদস্য কৃষক জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছেন বৈশাখীর কোন বাঁধ ভাঙ্গেনি এমনকি ক্লোজারগুলোও অক্ষত এবার বাঁধে কাজ নেই তাই কাজ শুরু হয়নি বিল পাওয়ার জন্য হয়তো সময়ের শেষের দিকে বাঁধে কিছু মাটিদিয়ে বিল তুলে নেবেনে পিআইসির লোকেরা। এখন পর্যণÍ কোন বাঁধ এলাকায় সাইনবোর্ড টানানো হয়নি। কৃষকরা বলছেন পিআইসর লোকেরা ইচ্ছা করে সাইনবোর্ড টানায়নি কারণ সাইনবোর্ডে টাকা ও মাটির পরিমাণ লেখা থাকে এবারতো মাটির কাজই নেই তাই মানুষ এসব দেখলে তাদের অসুবিধা হবে।
১৮ জানুয়ারি জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন করে দেখা যায় কিছু বাঁধে মাটির কাজ শুরু হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের ২-১৫ নং পিআইসি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ প্রকল্পেই কাজ শুরু হয়নি। ৪ নং পিআইসির সভাপতি মাহমুদুল হাসান ও ১৪ নং পিআইসির সভাপতি রেজাউল করিম এর বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে।ছাতক উপজেলার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে কাজ শুরু হয়েছে এমন বাঁধ আমরা পাইনি। তবে দোয়ারাবাজারে দু’একটি বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে।
এক সময় সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতেন ঠিকাদারেরা। ২০১৭ সালে হাওরে বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধের কাজ থেকে ঠিকাদারদের বাদ দেওয়া হয়। এর পর থেকে পিআইসির মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। তখন থেকে বাঁধের কাজে যুক্ত করা হয় প্রশাসনকে। এখন প্রশাসনের দিকেই কৃষকের বেশী অভিযোগ। একটি মহল এখনও সক্রিয় রয়েছে পিআইসি প্রথা থেকে ঠিকাদারী প্রথায় ফিরে যাওয়ার জন্য। এ বিষয়ে প্রশাসন ও কৃষকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান হাওর বাঁচাও আন্দোল নেতারা।