ডাক্তারদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ॥ রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণায় সময় দিন

10
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রান্তে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে “ দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরের সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৬০ শয্যা বিশিষ্ট ক্যান্সার, কিডনী ও হৃদরোগ ইউনিট” এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি বিশেষভাবে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এদেশের মানুষ কারও কাছে হাত পেতে চলবে না। পরনির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হবে। সেভাবেই আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে চাই। আর আমাদের দেশে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কিডনি ও হার্টের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এই ব্যাপারগুলো যখন বেশি দেখা যাচ্ছে, তখন জনগণকে বলব যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানলে সুস্থ থাকা যায়, সেগুলো মেনে চলুন। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সব বিষয়ে সবাইকে একটু বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে।
রবিবার দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৬০ শয্যা বিশিষ্ট হার্ট, কিডনি ও ক্যান্সার চিকিৎসার সমন্বিত ইউনিট স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকদের রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণায় কিছুটা সময় দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা অনিবার্য হওয়ায় চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি গবেষণা পরিচালনার জন্য আমরা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছি। ৮টি বিভাগে ৮টি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সেখানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি গবেষণার ক্ষেত্রে আপনারা নজর দেবেন সেটার একটা অনুরোধ আমার থাকল। তার জন্য যা যা ব্যবস্থা দরকার আমরা করব। তিনি বলেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো সেখানে চিকিৎসা সেবা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণাটা করা। আর আমাদের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের গবেষণাটা একান্তভাবে অপরিহার্য।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকা- সম্পর্কে অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্রও পরিবেশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাসের নতুন রূপ ‘ওমিক্রন’ থেকে সুরক্ষায় টিকা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রটোকল মেনে চলার জন্যও সকলের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে দেশবাসীকে ভয় না পেয়ে এবং কোন ধরনের অপপ্রচারে কান না দিয়ে টিকা নেয়ারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভয় না পেয়ে টিকাটা নিয়ে নিলে আপনাদের জীবনটা রক্ষা পাবে। একজন মানুষও যেন টিকাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ৩১ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে ১৩ কোটিরও বেশি টিকা দেয়া হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ ছাড়াও বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। কেননা আমাদের দেশের মানুষ সুস্থ এবং সুরক্ষিত থাকুক- সেটাই আমি চাই। তিনি বলেন, যেহেতু ওমিক্রন নতুনভাবে একটা আবার সারাবিশ্বে দেখা দিচ্ছে, এখানে আমাদের দেশের মানুষকে একটু স্বাস্থ্য সুরক্ষাটা মেনে চলতে হবে। আর শীতকালে প্রাদুর্ভাবটা বাড়ে। তাই জনগণের প্রতি অনুরোধ, খুব বড় সমাগমে যাবেন না। সেখান থেকে একটু নিজেদের সুরক্ষিত রাখবেন। আর কোন বড় সমাবেশ যেন না হয়, সেটার দিকে লক্ষ্য রাখবেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিটা সবাই মেনে চলবেন, সেটাই আমি চাচ্ছি।
করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও জনসমাগম এড়িয়ে চলার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলতে জনগণকে অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে শিশুদের ঝুঁকি বেশি। তাই ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের টিকা দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন সাপেক্ষে আরও কম বয়সী শিশুদের টিকা দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে এবং করোনার জন্য তার সরকারের দেয়া প্রণোদনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার জরুরী প্রয়োজনে বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ থাকার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে ভাল গবেষণা করে যাচ্ছেন। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা ভাল ও নামী-দামী চিকিৎসক হয়ে যান তারা তো চিকিৎসা সেবা দিতেই ব্যস্ত থাকেন, তারা যদি কিছুটা সময় ব্যয় করে এই গবেষণার দিকে নজর দেন- আমাদের দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া, জলবায়ু সবকিছু মিলিয়ে এদেশের মানুষের কি কি ধরনের রোগ দেখা দেয় এবং এর প্রতিরোধ শক্তিটা কিভাবে বাড়ানো যায় সেটার কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া যায়।
দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন শুরু হয়েছে উল্লেখ করে এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, দেশের জনসংখ্যার কথা চিন্তা করেই আমাদের এই ব্যবস্থাটা নিতে হবে। তার সরকারের সাভারে বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বায়োকেমিক্যাল, বায়োমেডিক্যাল, বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, অনকোলজি এসব বিষয়ে গবেষণার খুবই প্রয়োজন। এসব বিষয়ের প্রতি আপনাদের (চিকিৎসকদের) নজর দিতে হবে। কেন আমাদের দেশের মানুষ নানারোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে ক্যান্সার, কিডনি এবং হার্টের রোগের প্রাদুর্ভাব একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে জনগণকে বলব এসব ব্যাপারগুলো যখন বেশি দেখা যাচ্ছে তখন স্বাস্থ্যবিধিটা মানা এবং কি কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নিজেকে সুস্থ রাখা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সব বিষয়ে সবাইকে একটু সচেতন হওয়ার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ আমরা ইতোমধ্যেই জনগণের কাছে ক্যান্সার চিকিৎসা সহজলভ্য করতে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে হৃদরোগ, কিডনি ও ক্যান্সার রোগের সেবা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে আমাদের জনশক্তি গড়ে উঠুক। আর এই অতিমারীকে (করোনা) যেভাবে হোক আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং এজন্য মানুষের মঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যেন জাতির পিতার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একবারে তৃণমূলের মানুষটি পর্যন্ত অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। এ ব্যাপারে তার সরকার অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনকে বিনামূল্যে ঘর করে দেয়ার মাধ্যমে একটি ঠিকানা গড়ে দেয়াসহ তার সরকারের চলমান গৃহনির্মাণ কর্মসূচীর পাশাপাশি সারাদেশে বিদ্যুতায়ন এবং রাস্তা-ঘাট, পুল-ব্রিজ করে দেয়ার মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের মানুষ বুুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছে, কাজেই এই দেশ সবসময় বিশ^ দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে। কারো হাত পেতে চলবে না এবং পরনির্ভরশীল হবে না। আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাশীল হবে। সেভাবেই আমাদের দেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই। চিকিৎসা সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসার জন্য ’৯৬ পরবর্তী তার সরকারের চালু করে যাওয়া সারাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়ায় ২০০১ পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকারের সমালোচনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রী এগুলো বন্ধ করার সময় নিজেই বলেছিলেন এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যদি চালু থাকে তাহলে ওই অঞ্চলের জনগণ সব নৌকায় ভোট দেবে। অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক স্পৃহাই বড় হয়ে যায়, মানুষের সেবাটা নয়।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের খাদ্য, পুষ্টি ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের ফলে দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষের গড় আয়ু ২০০৮ সালের ৬৬ দশমিক ৫ বছর থেকে বর্তমানে ৭২ দশমিক ৮ বছরে এ উন্নীত হয়েছে। সরকার স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল চিকিৎসা সেবা অন্তর্ভুক্ত করেছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ওয়েব ক্যামেরা দিয়ে দেয়া হয় এবং বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকের পরামর্শ যাতে নেয় যায় সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। রেফারেল পদ্ধতির এবং টেলি মেডিসিন সুবিধা পাচ্ছে মানুষ। এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে আরও ডিজিটালাইজড করার পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে হার্ট, কিডনি, ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি এই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে উল্লেখ ছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সে প্রতিশ্রুতি পালন করছে। পাশাপাশি তার সরকার স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, জনসংখ্যা নীতি ২০১২, জাতীয় পুষ্টি নীতি ২০১৫ এবং জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬ প্রণয়ন করেছে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের পাশাপাশি ১৩ বছরে ১২টি বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন এবং ১১টি বিশেষায়িত হাসপাতালকে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল কর্মীসহ এখাতে জনবল নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে (ডিএমসিএইচ) ৫ হাজার শয্যার অত্যাধুনিক স্পেশালাইজড হাসপাতালে রূপান্তর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যা ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে। তাছাড়া, ১ বছরের নিচে এবং ৬৫ বছরের উর্ধে সকল নাগরিককে বিন্যামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার পরিকল্পনাও তার সরকারের রয়েছে।