যুগে যুগে মতভিন্নতার ধরন, প্রকৃতি এবং তার প্রতিকার

10

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইমাম লাইছ ইবনু সা’দ [৯৪-১৭৫ হি.] রহ. এর ও অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে। “ইবনু হাযম, আল-ইহকামু ফী উসূলিল আহকাম (কায়রো: দারুল হাদীস, ১৪০৪ হি.), খ. ৬, পৃ. ৩১৭; ইবুন ‘আবদিল বারর, জামি‘উ বায়ানিল ‘ইলম ও ফাদলিহি (দারুল ইবনি হাযম, ২০০৩ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৬৪” কাযী ইসলামঈল [২০০-২৮২ হি.] রহ. বলেন: “রাসূলুল্লাহ (স.) এর সাহাবীগণের মতভিন্নতার মধ্যে প্রশস্ততা রয়েছে- এ কথার একান্ত তাৎপর্য হলো, চিন্তা-গবেষণা করে রায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশশস্ততা। প্রশস্ততার অর্থ এ নয় যে, লোকের তাঁদের যে কারো মত গ্রহণ করবেন, যদিও তাঁর কথায় হক নিহিত না থাকে। “ইবনু ‘আবদিল বারর, জামি’উ বায়ান, খ.২, পৃ.১৬৪; শাতিবী , আল-মুওয়াফাকাত, খ.৫ পৃ. ৭৫”
ইবনু ‘আবদিল বারর [৩৬৮-৪৬৩ হি.] রহ. বলেন, “ইসমা‘ঈলের এ কথা অত্যন্ত চমৎকার। “ইবনু ‘আবদিল বারর, জামি‘উ বায়ান, খ. ২, পৃ. ১৬৪” একবার আমীরুল মু‘মিনীন ফিল হাদীস আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক [১১৮-১৮১ হি.] রহ. কে সাহাবীগণের ইখতিলাফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তাঁদের প্রত্যেকের কথাই কী সঠিক? তখন তিনি জবাব দেন, “সঠিক মত একটিই। তবে আমি আশা করি যে, ভুল মতটি তাঁদের নিকট নিকট বিবেচ্য হয়নি।” “আলÑখাতীব আলÑফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, খ. ১, পৃ. ৪০৩”
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ [৬৬১-৭২৮ হি.] রহ. এ দু ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সুন্দর সমন্বয় করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, মতানৈক্য যেমন কখনো রাহমাতের উপলক্ষ হতে পারে, তেমনি কখনো তা ‘আযাবের ও উপলক্ষ হতে পারে। তিনি বলেন: “ বিধি-বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে পরস্পর মাতনৈক্য কখনো রাহমাত হতে পারে। যদি সঠিক হুকমটি প্রচ্ছন্ন থাকার কারণে তা বড় ধরনের কোনো অনিষ্টের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। বস্তুতপক্ষে হক একটিই। কখনো এ হক প্রচ্ছন্ন থাকার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি রাহমাত হয়ে থাকে। কেননা এ হক সুস্পষ্ট হলে কখনো তাদের কষ্টে নিপতিত হতে হতো। এটা আল্লাহ তা‘আলার বাণী “তোমার এমন সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করো না, যদি তা তোমাদের জন্য প্রকাশ করা হয়, তা হলে তোমাদের খারাপ লাগবে।”- এর পর্যায়ভুক্ত। যেমন-বাজারে কারো থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। যারা এ ব্যাপারে অজ্ঞাত তাদের জন্য এগুলো হালাল। কিন্তু যারা এ ব্যাপারে অবগত যে, এগুলো অপহৃত সম্পদ, তাদের জন্য এগুলো ক্রয় করা জায়িয হবে না। কাজেই যে জ্ঞান জটিলতা তৈরি করে, তা জানা না থাকলে কখনো রাহমাত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে যে জ্ঞান সহজ অবস্থা তৈরি করে, তা জানা না থাকলে কখনো শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে সন্দেহ দূরীকরণও কখনো রাহমাতের উপলক্ষ হয়, আবার কখনো শাস্তির উপলক্ষ হয়।” “ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ২০০৫ খ্রি.) খ.১৪ পৃ. ১৫৯”
আমরা নিম্নে ইসলামে ফিকহী মতপার্থক্যের উৎপত্তি এবং স্বরূপ ও শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে তাঁর অনুসারীগণের মধ্যে কোনোরূপ মতপার্থক্য দানা বাঁধতে পারেনি। এ সময় যদিও ক্ষেত্রবিশেষ সাহাবা কিরাম (রহ.) এর মধ্যেও কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হতো; তবে তাঁর উপস্থিতির সুবাদে এ মমতপার্থক্য সহজেই নিরসন হয়ে যেতো। তাঁর যখনই কোনো সমস্যা বা মতপার্থক্যের সম্মুখীন হতেন, তখন রাসূলুল্লাহ (স.) এর শরণাপন্ন হতেন। তিনি তাঁদেরকে সঠিক ফঅয়সালাটি জানিয়ে দিতেন। তবে তখনকার এরূপ কিছু ঘটনার কথাও জানা যায় যে, সাহাবা কিরাম (রা.) কোনো অভিযানে মাদীনা থেকে বেশ দূরে অবস্থা করছিলেন এবং এমন সময় তাঁরা এরূপ কোনো পরিস্থিতি সম্মুখীন হন যে, যা নিয়ে তাঁদের মধ্যে রীতিমত মতপার্থক্য তৈরি হয় এবং তখন এ মতপার্থক্য নিরসনের জন্য তাঁদের পক্ষে মাদীনায় রাসূলুল্লাহ (স.) এর নিকট আসাও সম্ভব হতো না। ফলে তাঁরা মাদীনায় ফিরে আসতেন, তখন তাঁরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (স.) কে ঘটনাটি জানাতেন এবং সে সাথে তাঁদের নিজেদের ইজতিহাদগুলোও পেশ করতেন। রাসূলুল্লাহ (স.) ঘটনাটির পুরো বৃত্তান্ত শুনে হয়তো তাঁদের ইজতিহাদগুলোর বহান রাখতেন অথবা সঠিক ফায়সালাটি জানিয়ে দিতেন। সাহাবা কিরাম (রা.) সঠিক ফায়সালাটি জেনে খুশি হতেন এবং এভাবে তাঁদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও নিরসন হয়ে যেতো।
নিম্নে এরূপ কয়েকটি ঘটনার কথা আলোচনা করা হলো:
সাইয়িদুনা ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দক যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (স.) সাহাবীদের বললেন, “তোমাদের কেউ যেন বানূ কুরাইযা পৌঁছায় পূর্বে সালাত আদায় না করে।” পথে সালাতুল ‘আসরের সময় শেষ হওয়ার উপক্রম হলে একদল সাহাবী বললেন, এমনকি সময় পার হয়ে গেলেও বানূ কুরাইযায় পৌঁছার পূর্বে আমার সালাত আদায় করবো না। অপর সাহাবী বললেন, আমরা পথিমধ্যেই সময়মতো সালাত আদায় করবো। কেননা সালাত কাযা করানো রাসূলুল্লাহ (স.) এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং আমাদের গতি দ্রুত করাই ছিল তাঁর একান্ত উদ্দেশ্য, যাতে সালাতুল আসরের পূর্বে সেখানে পৌঁছা যায়। ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ কোনো দলকেই তিরস্কার করেননি। “ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, অধ্যায়: আল-মাগযী, পরিচ্ছেদ: মারজি ‘উন্নাবী (সা.) মিনাল আহযাব হা. নং- ৩৮৯৩” হাফি ‘আব্দুর রাহমান আস-সুহাইলী [৫০৮-৫৮১ হি.] রহ. ও অন্যান্য বিশিষ্ট মুহাদ্দিসগণ বলেন, এ হাদীস থেকে দুটি বিষয় বোঝা যায়,
এক. আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক অর্থের ওপর আমল করা যেমন দূষণীয় নয় তেমনি ইজতিহাদের প্রকিয়া অনুসরণ করে বিশেষ অর্থ গ্রহন করা ও নিন্দনীয় নয়।
দুই. শারীআহর অপ্রধান বিষয়সমূহে মুজতাহিদগণের সকলেই সঠিক। তাঁদের কাউকেই ভ্রান্ত বলা যাবে না। “ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ, ১৩৭৯ হি.) খ. ৭, পৃ. ৪০৯” কাজেই মত পার্থক্যকে কেন্দ্র করে পরস্পরের বিভাজনকে রাসূল্লাহ (স.) ভালো চোখে দেখেননি। তিনি এরুপ আচরণের নিন্দা কনেছেন সাইয়িদুনা আমর ইবনুর আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যাতুল সালাসিল যুদ্ধের সময় এক প্রচন্ড ঠান্ডা রাতে আমার স্বপ্ন দোষ হয়েছিল। এ সময় আমার আশঙ্কা হয়েছিল যে, যদি আমি গোসল করি তাহলে আমি মরে যাবো। ফলে আমি তায়াম্মুন করে সাথীদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করি। অভিযান থেকে ফিরে এসে তারা ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (স.) কে অবহিত করেন্ তিনি এটা শোনে বললেন “হে আমর! তুমি অপবিত্র অবস্থায় সাথীদের নিয়ে নামাজ পড়লে?! তখন আমি তাকে গোসল না করার কারণ জানালাম এবং বললাম যে, আল্লাহ তা‘য়ালা বলেছেন, তোমাদের নিজেদের মেরে ফেলো না। আল্লাহ তা‘য়ালা তোমাদের প্রতি পরম দয়ালুু। এ কথা শোনে রাসূলুল্লাহ (স.) হাসলেন; কিছু বললেন না। (অসমাপ্ত)