সুপ্রীমকোর্টের স্মরণিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ যারা খুনীদের আশ্রয় দেয় তাদের থেকে সবকও শুনতে হয়

8
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জাজেস স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রান্তে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ ও ‘বঙ্গবন্ধু এন্ড দ্যা জুডিসিয়ারি’ শীর্ষক বাংলা ও ইংরেজীতে মুজিব স্মারকগ্রন্থ এবং ‘ন্যায়কণ্ঠ’ শীর্ষক মুজিববর্ষের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর খুনীকে আশ্রয় দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য কথা বলে আর খুনীদের আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়। এটা কেন করে? আমি জানি না। তারা নাকি বিশ্বের সব থেকে গণতান্ত্রিক দেশ- যারা খুনীদের আশ্রয় দেয়, তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়, সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।
সবার জন্য ন্যয়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ন্যায়বিচার মানুষের প্রাপ্য। সেটা যেন সব সময় পায় সেটা আমরা চাই। আমরা যারা ১৫ আগস্ট সব হারিয়েছিলাম। বাবা-মা-ভাই সবাইকে হারিয়ে আমার মতো যেন কাউকে বিচারের জন্য চোখের পানি ফেলতে না হয়। কারণ আমরা ভুক্তভোগীরা জানি, বিচার না পাওয়ার কষ্টটা কি। সেটা আপনারা (বিচারপতি) নিশ্চিত করে দেবেন, সেটাই আমরা চাই। আর আমি যতক্ষণ সরকারে আছি, এর জন্য যা যা দরকার আমরা করব। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তটা খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
মঙ্গলবার বিকেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক জাতির পিতার জীবনে আইন, মামলা ও বিচার নিয়ে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু এ্যান্ড জুডিসিয়ারি’ শীর্ষক বাংলা ও ইংরেজীতে মুজিববর্ষ স্মারক প্রকাশনা গ্রন্থ এবং ‘ন্যায়কণ্ঠ’ শীর্ষক মুজিববর্ষের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণের মূল অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্য ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
জাতির পিতার খুনীদের আশ্রয় দেয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমেরিকার মতো জায়গা, যারা সব সময় ন্যায়বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, তারাই আবার মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু আমাদের যে মানবাধিকার লংঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি, যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার হলো, সেই খুনীদের তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আশ্রয় দিয়ে বসে আছে। নূরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে কানাডা, আর খুনী রাশেদ এখনও আমেরিকায়। তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়, সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।
জাতির পিতার খুনীদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সরকারে আসার পর থেকে (যুক্তরাষ্ট্রে) যতজন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, প্রত্যেকের কাছে বারবার অনুরোধ করেছি যে, একটা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কীভাবে আশ্রয় দেন, আপনাদের জুডিসিয়ারি কীভাবে আশ্রয় দেয়, কীভাবে আপনারা একটা খুনীকে আশ্রয় দেন? তাকে (খুনী রাশেদ) আজ পর্যন্ত ফেরত দিল না।
শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায় তুলে ধরে দীর্ঘদিন বিচার না পাবার নিজের আক্ষেপের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ছয় বছর প্রবাসে রিফিউজি হয়ে জীবন কাটানোর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আসলে বহু বছর বিচার না পেয়ে মনে অনেক দুঃখ ছিল। যা হোক, এই হত্যার বিচার পেয়েছি। এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। তিনি বলেন, তবে এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তটা খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার রায় কার্যকর হওয়ায় বিচার বিভাগ,দল ও দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি ।
অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সভাপতির বক্তব্য এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। আপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি এবং স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকার সম্পাদক মোঃ নুরুজ্জামান স্বাগত বক্তৃতা করেন। মুজিব স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকার ওপর অনুষ্ঠানে ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রচারিত হয়। এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা ও বঙ্গমাতাসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সকল শহীদ এবং বিজয়ের এই মাসে সকল মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বর্তমান সরকারের সময় নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি। বিচার বিভাগের অধিকারের জন্য, বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য বা দেশের মানুষের জন্য কী করেছি- সেটা আর আমি এত বেশি বলতে চাই না। তবে আমি এটুকু বলব, যেহেতু আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) চাইতেন স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, আমরা সরকারে এসে সেই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি।
অন্য সরকারগুলোর মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিচার বিভাগে কখনও হস্তক্ষেপ করেনি দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে অনেক ঘটনা আছে আপনারা জানেন। দেখা গেছে ফলস সার্টিফিকেটের ব্যবহার বা ছাত্রদলের কাঁধে হাত রেখে কাকে কী রায় দেয়া হবে সেটা নিয়ে আলোচনা! এ রকম বহু ন্যক্কারজনক ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। অন্তত আমি এটুকু বলতে পারি যে, আমরা সরকারে আসার পর, অন্তত এই পর পর তিনবার এখন আমরা ক্ষমতায় বা এর আগে একবার ছিলাম, আমরা কিন্তু সেটা করার সুযোগ নেইনি। সব সময় একটা ন্যায়ের পথে যেন সবাই চলতে পারে আমরা সেই ব্যবস্থা করেছি।
স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা দেখবেন একের পর এক আমরা কাজ করে গেছি। দ্বিতীয়বার যখন এসেছি, তখন আমরা ‘দ্য কোর্ট অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর সংশোধন বিল-২০০৯’ পাস করে বিচার বিভাগ পৃথিকীকরণকে স্থায়ী রূপ দিয়েছি। এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও যেন বিচার বিভাগ স্বাধীনতা অর্জন করে সেই ব্যবস্থাটাও কিন্তু আমি ’৯৬ সালে এসে করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এসে সব রকম সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোহয়। এর মাঝে আপনারা জানেন বিভিন্ন জেলায় বোমা মেরে বিচারকদেরও হত্যা করা হয়েছে। সেখানে আমরা তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সব সময় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। আমাদের দেশটাও যেন বিশ্বে একটা মর্যাদা নিয়ে চলবে, সেই সঙ্গে একটি দেশের সব অঙ্গও যেন সেভাবে মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে, আমরা সেটাই করতে চাই। সেভাবেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিচারকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিচারকদের থাকার ব্যবস্থা, তাঁদের চলার ব্যবস্থা, সব ধরনের ব্যবস্থা, সুযোগ-সুবিধা আমরা সাধ্যমতো করে দিয়েছি।
বিচারকদের দক্ষতা বাড়াতে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আইন কমিশন আমরা গঠন করি। বিচারকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আমি প্রতিষ্ঠা করে দেই। এখন তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রেনিং নেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অন্য দেশে কীভাবে হয় সেটা আমাদের দেশের মানুষের জানা উচিত, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি।
সরকারপ্রধান বলেন, গ্রামের যেসব হতদরিদ্র মানুষ বিচার পায় না, তাদের জন্য লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন এবং এ জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। গরিব সাধারণ মানুষ যেন বিচার পায় সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। এটা আমরা ২০০০ সালে প্রণয়ন করেছি। অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আগে মাত্র হাতে গোনা ৭ জনের বেশি বিচারক বসতে পারতেন না, আমরা এনেক্স ভবন করে দিয়েছি। ৪০টা চেম্বারের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পাশাপাশি প্রত্যেকটা জেলা কোর্ট নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।
উচ্চ আদালতে নারী বিচারক নিয়োগে নিজের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান আমলে যে আইন ছিল সেখানে বিচার প্রক্রিয়ায় নারীরা অংশ নিতে পারবে না। জাতির পিতা সেই আইন পরিবর্তন করে সুযোগ দিলেন। আমি সরকারে এসে দেখলাম, আমাদের উচ্চ আদালতে কোন নারী বিচারক নেই। আমি অনুরোধ করলাম প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রপতিকে যে, সেখানে নারীদের সুযোগ দিতে হবে।
জাতির পিতার হত্যার বিচার হলেও এ নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তটা খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রেখে গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারাটা অব্যাহত আছে বলেই আজকে বাংলাদেশ এই উন্নতিটা করতে পেরেছে।
দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে গিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা মোকাবেলা করতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কখনও সেই হেফাজতকে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, জ্বালাও-পোড়াও করা, কখনও অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টি করা, নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তা মোকাবেলা করেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।