ক্ষতি যেটা হয়েছিল

2

জাহীদ রেজা নূর :

ডিসেম্বরে এসে পরিকল্পিতভাবে তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করায় আমাদের দেশের জন্য তা কত বড় ক্ষতির কারণ হয়েছিল, সেটি এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক সচিব রাও ফরমান আলীর সঙ্গে মিলেছিল আলবদর বাহিনী। মিলেছিল সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ এবং ইয়াহিয়ার উচ্ছিষ্টভোগী অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। পাকিস্তান ভেঙে গেলে বাংলাদেশ যেন মেধাবী মানুষের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, এ চেষ্টা করেছে তারা প্রাণপণ। তারা সফলও হয়েছে। যে বিজয় এসেছে, সেটিকে ঠিকভাবে লালন করতে না পারার একটা বড় কারণ হলো- যারা দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন, তাদের বঙ্গবন্ধু পেলেন না পাশে।
জাতির দিকনির্দেশনা দেওয়া সহজ কাজ নয়। লোভ, মোহ, স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়। সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রবহমান জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে দেশকে গড়ে তোলার যে আকাক্সক্ষা দেখা যায় বুদ্ধিজীবীর মননশীলতায়, সেটিই এগিয়ে দেয় জাতিকে। সবাই পথ বাতলে দেন না, কেউ কেউ দেন। আর ওই দেখানো পথ ধরেই চলেন বাকিরা। এটিই নিয়ম হয়ে গেছে। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসেও সেটি সত্য। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরই পাকিস্তান নিয়ে যে মোহ ছিল, সেটি কেটে যেতে শুরু করেছিল।
১৯৪৭ সালের একটু আগে-পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা। জিন্নাহর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি মূলত গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দেশভাগের আগে আগে তিনি হয়ে উঠলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতা। দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসস্থল গড়ে তোলার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিলেন। এর পর যখন ভূগোলের সব নিয়ম ছিন্ন করে ভারতের এদিকে আর ওদিকে দুটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠল পাকিস্তান নামের দেশটি, তখন থেকেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। ওই ষড়যন্ত্র চলল একীভূত পাকিস্তানের গোটা সময়টায়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা প্রমাণ করলেন, তারা আসলে বাঙালিদের প্রভু হতে এসেছেন। ব্রিটিশ আমলে যেমন ভারতীয়রা ছিল ব্রিটিশ প্রজা, তেমনি পাকিস্তানে বাঙালিরাও ছিল পাকিস্তানি প্রজা। ব্রিটিশরা যেমন ভারতের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, পাকিস্তানিরাও বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করতে লাগল। সবচেয়ে বড় মারটা এলো ভাষার ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালি হলেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারাই আসলে পাকিস্তান সম্পর্কে, জিন্নাহর সম্পর্কে বাঙালিকে মোহমুক্ত করল।
কথাগুলো বলার প্রয়োজন হলো এই কারণে যে, এখন কেউ কেউ প্রগতিশীল মানুষের চরিত্র হনন করতে গিয়ে বলেন- তিনি তো ওই সময় পাকিস্তানের জয়গান গেয়েছেন, জিন্নাহর স্তুতি করেছেন। যারা এসব কথা বলেন- তাদের কেউ কেউ জ্ঞানপাপী, কেউ কেউ ইতিহাস সম্পর্কে অচেতন। ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান কায়েম করা। কেন, সেটিও সবাই জানে। দেশের বড় বড় জমিদারি, ব্যবসাসহ নানা কিছু ছিল হিন্দুদের হাতে। মুসলমানদের জন্য একটি দেশ হলে সম্পত্তিগুলোর ওপর মুসলমানের অধিকার আসবে- এটি কম লোভনীয় বিষয় ছিল না। তা ছাড়া ওই সময় কংগ্রেসসহ যে দলগুলো রাজনীতির মাঠে ক্রিয়াশীল ছিল, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিল যে, মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকেও তারা অগ্রাহ্য করতে শুরু করেছিল। ফলে দেশভাগটি এমনভাবে হলো- যাতে সবচেয়ে বঞ্চিত হলো বাংলা। লাহোর প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে ভারতের দুই দিকে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের কথা থাকলেও সেটি হয়ে গেল একটি পাকিস্তান। ওই সময় বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের চিন্তায় ছিল বিভোর, জিন্নাহর চিন্তায় ছিল বিভোর। ফলে জিন্নাহকে নিয়ে যদি ওই সময় তারা মোহগ্রস্ত হয়ে কিছু লিখে থাকে, বলে থাকে- তা হলে সেটি ছিল হৃদয়োৎসারিত। তখনো পাকিস্তান বা জিন্নাহর কদর্যরূপটি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় প্রবেশ করা দরকার। ডিসেম্বরে হত্যা করার জন্য যাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সময়ে তাদের নানা ধরনের অবদান ছিল। কেউ লেখালেখি করে, কেউ পড়িয়ে, কেউ কলাম লিখে, কেউ সংস্কৃতির জয়গান করে বাংলা ও বাঙালির একটি ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। ফলে শুধু একাত্তরে তারা কে কী করেছেন, এর ওপর নির্ভর করেনি পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দালাল-দোসব আলবদররা। বর্তমানের পাশাপাশি তাদের অতীত কর্মকা-কেও আমলে নিয়েছিল তারা।
কেন অতীত কর্মকা-কেও আমলে নেওয়া হয়েছিল? এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মূলত ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এ দেশের মানুষের স্রোত যখন নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে বাঁক নিল, তখন থেকেই আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ ধারণা ভিত্তি পেতে থাকল। নিজ সংস্কৃতির প্রতি নিমগ্ন থাকার অর্থ হলো, অন্যের চাপিয়ে দেওয়া জীবনাচরণকে অগ্রাহ্য করার সাহস অর্জন করা। যে বুদ্ধিজীবীদের আমরা হারিয়েছিলাম পরিকল্পিত হত্যাকা-ের ষড়যন্ত্রে, তারা ওই সাহস অর্জন করেছিলেন। তারা বাঙালিকে বুঝিয়েছিলেন, অতীতকে নিয়েই এগোতে হয়। অতীতেই থাকে শিকড়বাকড়। অতীতের আলোকেই তৈরি করতে হয় বর্তমানকে, এগিয়ে যেতে হয় ভবিষ্যতের দিকে। আর ওই কথা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, একটি সমাজে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই বাস করে একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে। ধর্মে ধর্মে অথবা বর্ণে বর্ণে বিরোধ লাগিয়ে দেয় একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ। এই ঝগড়া বাধিয়ে তারা ফায়দা লোটে। ওই সময় অসাম্প্রদায়িকতা নির্বাসনে যায়। এক ধর্ম আরেক ধর্মের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ষড়যন্ত্র করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে ভিটে ছাড়া করে, তাদের জন্য ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
এসব নেতিবাচক অপকর্মগুলোকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তৈরি করেন একটি স্বচ্ছ জীবন-দর্শন। সেখানে অসাম্প্রদায়িতা হয়ে ওঠে বড় একটি উপাদান। সেখানে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে অন্য সংস্কৃতিকে নিজ সংস্কৃতির কাছে নিয়ে আসার প্রণবতা কাজ করে, মানুষ বিনয়ী হয়। কিন্তু কখনো কখনো জাতীয়তাবাদী প্রচারণার কারণে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করার দুর্বুদ্ধিও এসে প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ওই বাধা কেটে বেরিয়ে আসার জন্যও প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক মানবিক জীবনযাপন।
১৯৭১ সালের পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর থেকে। কাদালেপা মাইক্রোবাসে করে এদিন মধ্যরাতের পর থেকে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করা শুরু হয়েছিল। এর পর বিজয় দিবস পর্যন্ত প্রতিদিন তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করেছে। বিজয়ের পর রায়েরবাজার আর কাঁটাসুরের বধ্যভূমিতে তাদের কারও কারও লাশ পাওয়া গেছে, কারও লাশ পাওয়া যায়নি। কেন তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পথ বেছে নিল, এ কথা নিশ্চয়ই এ সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর একটু হলেও বোঝা যাবে। নানাপথে বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টি করছিলেন বলেই তাদের হত্যা করা হয়েছিল।
ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পেয়েছিল ওড়ার আকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাটির মানুষের ভাষায় সরলভাবে বর্ণনা করে গেছেন এ দেশের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ ও বঞ্চনার কথা। রাজনীতিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর ওই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তারাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ওই শোষণ ও বঞ্চনাকে। কেন পাট ফলান এ দেশের চাষি আর এতে সমৃদ্ধ হয় পশ্চিম পাকিস্তান- এ সহজ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েই সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো সম্ভব হয়েছিল।
উদাহরণ হিসেবে আমি আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনের কথা বলতে পারি। পাকিস্তান আমলজুড়েই তিনি তার দিকনির্দেশনামূলক সাংবাদিকতা চালিয়ে গেছেন। অবরুদ্ধ নগরীতে বসে তিনি তার যে লেখাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলোর দিকে তাকালেও বোঝা যাবে কতটা বুকের পাটা থাকলে কৌশলে এই ভাষায় কথা বলা যায়। ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’, ‘অধুনা রাজনীতির এক অধ্যায়’, ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’, ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ’ ইত্যাদি লেখার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, ওইদিনগুলোয় বুদ্ধিজীবীরা কী করছিলেন। আর দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা? না, তারা এ দেশে বসেই দেশের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন। এর প্রমাণও আছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পাঠানো গোপন বার্তাগুলোর কথা এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দিতে হয়। মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের গোপন রিপোর্টটি সিরাজুদ্দীন হোসেন মারফতই পৌঁছে গিয়েছিল প্রবাসী সরকারের হাতে। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ওই কাজগুলো করে চলেছিলেন। আরও একটা কথা। গোটা দেশ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ যুদ্ধটা করেছেন বাংলাদেশে বসেই। এ বিষয়ে গভীর গবেষণার প্রয়োজন আছে।
শুরুতেই বলেছিলাম, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড আমাদের দেশে কত বড় ক্ষতির কারণ হয়েছিল, তা আমরা এখন বুঝতে পারছি। বড় দুটি গর্ত দেখতে পারছি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতায়। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দেশটিকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত হতে শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু সামগ্রিকভাবে মেরুদ- নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো ব্যক্তিদের আমরা প্রায় পাইনি বললেই চলে। ফলে নানা ধরনের বিভ্রান্তি থেকে উঠে আসার সুযোগ ঘটেছে কম। গণতন্ত্র মার খেয়েছে, অসাম্প্রদায়িকতা মার খেয়েছে। আমি বলব, বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের সবচেয়ে বড় ক্ষতটা এ জায়গাতেই। জাতিকে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন করে তোলা ও অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করার মানুষের খুব অভাব আজ। আমরা সেটি বুঝতে পারছি কিনা জানি না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।