দুর্নীতিবাজদের বয়কট করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির ॥ অভিযান নিজ ঘর থেকে শুরুর পরামর্শ দুদককে

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, দেশ ও সমাজ থেকে যে কোন মূল্যে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। অন্যের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আগে নিজেদের অনিয়ম ও অসততা দূর করতে হবে, তাই অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পরামর্শ দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন পরামর্শ দেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদের রেকর্ড করা বক্তব্য প্রচার করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ সময় দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক এবং প্রতিষ্ঠানটির সচিব মুঃ আনোয়ার হোসেন হাওলাদারসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তিনি বলেন সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই সমাজে এই দুর্নীতি হ্রাস পাবে। এ সময় তিনি দুদকের সব পর্যায়ের কর্মীদের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানান। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে কিছুসংখ্যক লোকের জন্য যাতে পুরো দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয় সে দিকেও লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যের যোগসূত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের উচ্চকৃত কণ্ঠ বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘আপনার অধিকার, আপনার দায়িত্ব : দুর্নীতিকে না বলুন’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ হয়েছে বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘ ঘোষিত দুর্নীতিবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমনে অঙ্গীকারবদ্ধ। দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ তথা সমাজে সততা এবং নিষ্ঠাবোধ বিকাশের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশই এর কু-প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। সামাজিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগ্রত না হলে কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের একার পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরি এবং দুর্নীতগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোন মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
কমিশনের সব পর্যায়ের কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি কমিশনের সব পর্যায়ের কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আগে নিজেদের অনিয়ম ও অসততা দূর করতে হবে। যারা রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবে তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে এবং দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। জনমনে এমন ধারণা জন্মাতে পারলেই দুদকের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে। আব্দুল হামিদ বলেন, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের কৌশলও বদলেছে। তাই তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে দুদককেও আরও কৌশলী হতে হবে, প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। রাষ্ট্রপতি বলেন, একজন দুর্নীতিবাজের পরিচয় শুধুই একজন দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক, দুর্নীতি করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আগামী দিনগুলোতে দুদককে দুর্নীতি দমনে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি আশা করব, আপনারা নিজেদের ঘর থেকেই এ অভিযান শুরু করবেন। কিছুসংখ্যক লোকের জন্য যাতে পুরো দুর্নীতি দমন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখবেন। প্রবাদে আছে, ’এই দুনিয়ায় হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি। রাজার হস্ত করে কাঙ্গালের ধন চুরি’। মানুষের চাওয়া পাওয়ার আকাক্সক্ষা ক্রমশ বাড়তে থাকে। চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সামর্থ্যরে সামঞ্জস্য না থাকলেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। তাই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে জীবনধারণে অভ্যস্ত হলেই সমাজ থেকে দুর্নীতি হ্রাস পাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।
এর আগে সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, শুধু একটি আইন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মঈনুদ্দিন আব্দুল্লাহ বলেন, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে তারা যেন অংশীজন হয়, এ দায়িত্ব মানুষের মধ্যে সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হয়। তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা সরকারীভাবে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসটি পালন করছি। দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এতে প্রশাসন, সুশীল সমাজ, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণ অংশ নেবে। ঢাকায় আটটি জায়গায় মানববন্ধন হবে। একইভাবে দেশের সব জেলা-উপজেলায় মানববন্ধন হবে। এর উদ্দেশ্য জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে দুদক আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশ নেন। মানববন্ধনে দুদকের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুুল্লাহ বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অনুসন্ধান ও তদন্তে যে দীর্ঘসূত্রতা আছে, ওটা কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে পরিকল্পনা করা। আমরা বাস্তবভাবে পরিকল্পনা করছি দুর্নীতি নিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশা, এর কাছাকাছি যাওয়ার।