বেগম রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে নানা ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন নেতৃত্বের পর্যায়ে এগিয়ে এলেও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ না হওয়ায় নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কেবল আইন করে নয়, মানসিকতার পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোুধ করতে পারে। এই বিশ্বাসটা করতে হবে যে নারীরা শুধু ভোগের বস্তু নয়, নারীরা সহযোদ্ধা। নারীরা সহযোগী। সহযাত্রায় চলতে হবে। সমান অধিকার দিতে হবে, এটা হলো বাস্তবতা। সেভাবেই কাজ করতে হবে। বৃহস্পতিবার ‘বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন’ এবং ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমাদের জন্য পীড়াদায়ক, তা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। আমরা যদিও আইন করে দিয়েছি, যেমন আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন করেছি। আমরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, পারিবারিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন করে দিয়েছি। কিন্তু শুধু আইন করলে হবে না, এখানে মানসিকতাটাও বদলাতে হবে। চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আনতে হবে এবং বিশ্বাসটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। আজ শিক্ষা-দীক্ষায় কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজ করতে পারছে বলেই তার সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে। সরকারপ্রধান বলেন, জাতির বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই আমাদের দেশের নারী সমাজকে জাগ্রত করতে হবে। কেননা, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যেখানে নারী, কাজেই তাদের পেছনে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটা জাতির পিতা যেমন মনে করতেন, তেমনি বেগম রোকেয়াও তার লেখনীতে বলে গেছেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ সায়েদুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন।
নারীশিক্ষায় কুমিল্লার অধ্যাপক হাসিনা জাকারিয়া বেলা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যশোরের অর্চনা বিশ্বাস, নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় কুমিল্লার শামসুন্নাহার রহমান পরাণ (মরণোত্তর), সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ড. জিনাত হুদা এবং পল্লী উন্নয়নে কুষ্টিয়ার গবেষক ড. সারিয়া সুলতানা এ বছরের বেগম রোকেয়া পদক লাভ করেন। পদকপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে রেপ্লিকাসহ স্বর্ণপদক, সম্মাননাপত্র এবং নগদ অর্থের চেক প্রদান করা হয়। পরে বিজয়ীদের পক্ষে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে অধ্যাপক হাসিনা জাকারিয়া বেলা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। ‘নারীদের বেশি লেখাপড়া শিখিয়ে কি হবে, তারাতো পরের ঘরে চলে যাবে’-এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজে বিদ্যমান ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে কারণেই জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সরকার নারীদের অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা নিশ্চিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বেগম রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমি মনে করি অনেকটাই আমরা সে স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয়েছি।
রংপুরের পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার বাড়িটি সংরক্ষণ করে সেখানে নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং রংপুরে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় করার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটা সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সর্বক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিমান, হেলিকপ্টারও নারীরা চালাচ্ছে। আমাদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের নারী অফিসার পুলিশ এবং আমাদের সেনাবাহিনী বা বিমানবাহিনীর মেয়েরা অত্যন্ত চমৎকার কাজ করছেন। এখন আমাদের নারীদের অংশগ্রহণটা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে বা পুলিশ বাহিনীতে, শান্তিরক্ষা মিশনে নারীদেরকে বেশি চায়। এটা হলো বাস্তবতা।
নারীরা এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় গিয়েও কাজ করছে, সে কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, এটাই সব থেকে বড় কথা যে পুরুষরা যেটা পারে, নারীরা তার থেকে আরও ভাল পারে, বেশি পারে। তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং সেটাই প্রমাণ হয়েছে। এ সময় রসিকতা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাই হোক, আমি বেশি বলব না, শেষে আবার দেখা যাবে যে আমার ভোট না কমে যায়। আমাদের তো ইলেকশন (নির্বাচন) করে আসতে হয়, আমাদের সব দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। অনুষ্ঠানে আজকের দিনটি তার কন্যা এবং বাংলাদেশের অটিজম আন্দোলনের অগ্রপথিক সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিন উল্লেখ করে সকলের কাছে তার জন্য দোয়া চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এক সময় এই অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুরা জন্ম নিলে বাবা-মা তাদেরকে লুকিয়ে রাখত, বলতে পারত না। কোন মা এমন সন্তান জন্ম দেয়ায় পরিবারে অনেক সময় লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। এমনকি, এমন শিশু জন্ম দিলে তাকে স্বামী তালাক দিয়েছে বা আরেকটা বিয়ে করেছে। এ ধরনের একটি অবস্থা সমাজে ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা বিরাট পরিবর্তন সায়মা ওয়াজেদ আনতে পেরেছে, তার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই আজ অটিজম আক্রান্তরা সমাজের মূলধারার সঙ্গে মিশে যেতে পারছে, স্বীকৃতি পেয়েছে। অটিজম শিশুদের কোন মা-বাবাই লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর লুকিয়ে রাখেন না। বরং গর্বের সঙ্গে বলে, সেই মানসিকতারও পরিবর্তন এসেছে।
নারীশিক্ষা এবং নারীর স্বনির্ভরতার ওপর জাতির পিতা সব সময় গুরুত্ব দিতেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে তিনি সব শ্রেণীর নারীর অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাদের সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট সমাধানের কথাও তিনি বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা লেখাপড়ার প্রতি সব সময় গুরুত্ব দিতেন এবং বলতেন, একটা মেয়ে যদি ১০ টাকা কামাই করে তার আঁচলে বেঁধে পরিবারে আসে তাহলে সেই পরিবারে মেয়েদের একটা মূল্য থাকে।’ তিনি বলেন, মেয়েরা উপার্জন করলে তাদের যে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আসবে সে কথাই জাতির পিতা বলে গেছেন এবং যে কারণে নারী শিক্ষা অবৈতনিক করে দেন তিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু মনে করতেন শিক্ষাই নারী মুক্তির একমাত্র পথ।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ করে দিতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক বাধ্যতামূলক করেছি। এই সিদ্ধান্তের পর অনেক বাবা-মা মেয়েদের আর বাধা দেয়নি। অন্তত মেয়ে যে একটা চাকরি পাবে সেটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তা ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। সারাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে তোলা ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে উদ্যোক্তা দু’জনের একজন নারী হতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা যে বিনামূল্যে গৃহহীনকে ঘর দিচ্ছি সেখানে নারী-পুরুষ দু’জনের নামে মালিকানা থাকলেও সমস্যার সৃষ্টি হলে মালিকানা নারীর নামেই বহাল থাকবে। পাশাপাশি নারী উদোক্তাদের কম সুদে ঋণও দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নারীকে তার কাজের স্বীকৃতি দিতে আমরা এ বছর থেকে জাতীয় পর্যায়ের সম্মাননা ‘বঙ্গমাতা পদক’ প্রবর্তন করেছি। সামাজিক অচলায়তন ভেঙ্গে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু বাধা আসে, আসবে। সেই বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বেগম রোকেয়ার অপর একটি লেখনীর উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ হইয়া পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে?’
প্রবল বাধার মুখেও দেশে প্রমীলা ফুটবল চালুর প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলাধূলায় মেয়েদের তো অংশগ্রহণ করতেই দিত না। যাই হোক দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসলাম, অন্যভাবে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তিনি সে সময়ে স্কুলপর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোল্ডকাপ এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং প্রাথমিক স্কুলপর্যায় থেকে ছেলে ও মেয়েদের ফুটবল দল গঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলার উদ্যোগও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এভাবে ছোটবেলা থেকে শুরু করায় এখন আর সেই বাধা নেই। অর্থাৎ অচলায়তন ভেঙ্গে একবার এগিয়ে যেতে পারলে আর কোন বাধা আসবে না।
আমাদের ধর্মে নারীর অধিকার প্রদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্মে তো মেয়েদের অধিকার দেয়াই আছে। সেখানেই তো সম-অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে এ ধরনের কিছু বাধা আসে, আসবে। সেই বাধা আমাদের অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, পুরুষশাসিত সমাজ আমরা বলি। কিন্তু মেয়েদের ছাড়া পুরুষরা কী পথ চলতে পারে? পারে না। মায়ের পেটে জন্ম নিতে হবে, বোনের হাত ধরে হাঁটা শিখে, বড় হয়ে স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল থাকে, বৃদ্ধ হয়ে গেলে তো কন্যা সন্তানই বেশি দেখে, সে-ই যত্ন নেয় বেশি, এটাও তাদের মনে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেগম রোকেয়া আমাদের আদর্শ। তিনি নারীদের পথ দেখিয়েছেন। তার সময়ে সমাজে নারীদের লেখাপড়া যেন অপরাধ ছিল। সেই অবস্থা থেকে তিনি নারী জাগরণে কাজ করেছেন। এখন মেয়েরা কোন দিক থেকে পিছিয়ে নেই। তিনি দেশের শতভাগ গৃহে আলো জ¦ালবার পাশাপাশি দেশের সকল গৃহহীনকে ঘর করে দেয়ার মাধ্যমে একটা ঠিকানা গড়ে দেয়ায় তার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করে একটি শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সাফল্যের জন্য জনগণকে কৃতিত্ব দিয়ে ভবিষ্যতেও এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।