বিজয়ের মাস

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত / ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে/ দামামা বাজিয়ে দিগি¦¦দিক/ এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’
বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালির অহঙ্কার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। তবে এবার বিজয়ের মাস এসেছে এক অনন্য গৌরবের ইতিহাস নিয়ে। বাড়তি ইতিহাস হলো মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাস শুরু হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন শেষে এবার শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণগণনা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী, পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ’। লাল-সবুজ পতাকা উর্ধে তুলে ধরে বিজয়ী বাঙালীরা। সেই পতাকা উঁচিয়ে চলছে প্রগতির পথে বাঙালির অভিযাত্রা। প্রগতির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অন্ধকারের অপশক্তিকে পরাজিত করে বাংলাদেশের আরও অদম্য গতিতে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখছেন স্বাধীনতার পক্ষের সকল বীর বাঙালীরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হাজারও বছরের শৃঙ্খলিত দাসত্বের শিকল ছিন্ন করে জাতি দেখেছিল স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন। সেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল লাল-সবুজের এক জাতীয় নিশান, অর্জিত হয়েছিল এক বাংলার মানচিত্র। আগামী ১৬ ডিসেম্বর সেই অর্জিত বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস। বিজয়ের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এক অন্যরকম অনুভূতি এবং বর্ণাঢ্য উৎসব-আনন্দে মেতে উঠবে গোটা জাতি।
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে, তার নাম ডিসেম্বর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশজুড়ে চলমান ‘মুজিববর্ষ’-এর মধ্যেই শুরু হলো বাঙালির কাক্সিক্ষত মুক্তিসংগ্রামে বিজয় অর্জনের মাস ডিসেম্বর। আগামী ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে বাংলাদেশ। আর এরমধ্য দিয়েই এক বছর ধরে চলা মুজিববর্ষ উদযাপনের সমাপ্তি ঘটবে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনটিকে সামনে রেখে এবারের বিজয়ের মাস বিশেষ তাৎপর্য বয়ে এনেছে পুরো জাতির জীবনে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ হয়েছিল মহান বিজয়ের মাসে। বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে স্মরণ করা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যাঁদের আত্মত্যাগে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামক এক ভুখন্ডের। দেশকে স্বাধীন করার জন্য বাঙালি জাতিকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক দীর্ঘ পথ। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ।
তবে এবার এক ভিন্ন আবহে এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এখনও বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসের চোখ রাঙানি বন্ধ হয়নি। কিন্তু সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর এ বছর জাঁকজমকপূর্ণভাবেই বিজয় দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাঙালির দুটি সুমহান অর্জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্মশতবর্ষকে ঘিরে বিজয়ের মাস এই ডিসেম্বরে বাঙালি জাতি নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে নতুন করে শপথ নেবে।
মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজারও বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্ত স্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূ-খন্ডের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানরা ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাঁথা বিজয় অর্জনের মাস।
দেশকে স্বাধীন করার জন্য বাঙালি জাতিকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক দীর্ঘ পথ। পশ্চিম পাকিস্তানীদের চরম নিপীড়ন, শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, যার যা কিছু আছে তা নিয়েই সংগ্রামের পথ দেখান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দরাজ কণ্ঠে হুঙ্কার দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। বাঙালির পাল্টা জবাবে যুদ্ধ স্থায়ী হয় ৯ মাস। দীর্ঘ ৯ মাসের এই সংগ্রামে প্রাণ হারায় ৩০ লাখ শহীদ। ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো এবং দেশের বিপুল ক্ষতিসাধন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
এমন প্রেক্ষাপটে আবারও ফিরে এলো বিজয়ের মাস। আজ ১ ডিসেম্বর। ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরেই বাঙালীর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখেই আমরা পেয়েছিলাম দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, একটি লাল সবুজের পতাকা। তাই ডিসেম্বর মাস বাঙালী জাতিসত্ত্বা আর নিজস্ব ভূমির গৌরবদৃপ্ত বিজয় ও অহঙ্কারের মাস।
গত কয়েকবছরের মতো এবারের বিজয়ের মাসও শুরু হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরাজিত করার সুদৃঢ় দাবির মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী একটি অশুভ গোষ্ঠী স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নতুন করে দেশে অস্থিতিশীল সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। অন্ধকারের এই অপশক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে মেতেছে। তাই এবারের বিজয়ের মাসজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশের পাশাপাশি মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে সেই ঐক্যের আহ্বানও থাকবে সারাদেশে।
প্রতিবছরের মতো এবারও বিজয়ের মাসে দেশবাসী বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হবে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শোকে মুহ্যমান হয়ে মাথা নোয়াবে অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। নানা আয়োজনে সবার চেতনতায় ধ্বনিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাঁথার স্মৃতিচারণ আর বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর বিজয়ের স্মারক ডিসেম্বরের প্রথম দিনটিতে বিভিন্ন দল ও সংগঠন আজ দেশজুড়ে পালন করবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-আর্থিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানবোধ জাগানোর লক্ষ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি পালিত হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে দেশের ২১টি স্থানে মহাসমাবেশের মাধ্যমে ‘পথে পথে বিজয়’ উদযাপন করা হবে।