জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ায় ভাসানচরে আগ্রহ বাড়ল রোহিঙ্গাদের ॥ নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হচ্ছে স্থানান্তর

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ায় বেজায় খুশি রোহিঙ্গারা। এ খবর চাউর হওয়ার পর থেকে ভাসানচরে যেতে আগ্রহ বেড়েছে রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে উখিয়া টেকনাফে ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক রকমের আতঙ্ক বিরাজ করলেও রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ায় সেখানে যাবার জন্য রোহিঙ্গাদের নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ রাশেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ার খবরে খুশি হয়ে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে আগের মতো নিরাপদে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। শীঘ্রই ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুকদের নাম ঠিকানা রেজিস্টারভুক্ত করা হবে।
ক্যাম্প ইনচার্জ রাশেদুল আরও জানান, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু করা হবে। উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে। ইতোপূর্বে ৬ দফায় ১৮ হাজার ৫২১ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। আরও ৮০ হাজারের বেশি তথা মোট এক লাখ রোহিঙ্গাকে নবেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের মধ্যে ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় উখিয়ার কুতুপালং-২ ইস্ট ক্যাম্পে শত শত রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে উল্লাস করেছে। রোহিঙ্গা নারী শিশুদের মধ্যে বিতরণ করেছে মিষ্টি। সমবেত হয়ে জানান দিয়েছে যে, তারা ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক।
সূত্র জানায়, উখিয়া টেকনাফে স্থাপিত আশ্রয় শিবিরগুলোতে এ পর্যন্ত কয়েকটি এনজিওর পক্ষে রোহিঙ্গাদের যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ভাসানচরে যাবার পর ওইসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভেবে অনেকে পালিয়ে এসেছে ভাসানচর থেকে। এখন রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হয়েছে দেখে রোহিঙ্গারা যেসব সুবিধা উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে পেত, বর্তমানে ভাসানচরেও সেসব সুবিধা মিলবে বলে ধারণা করছে তারা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যেখানে সুযোগ সুবিধা বেশি পাবে-রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে হুমড়ি খেয়ে চলে আসবে। উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে যারা দোকানপাট, স্বর্ণ ও মাদক কারবারে জড়িত, তারা কখনও সীমান্ত এলাকা ছেড়ে কোথাও স্থানান্তর হবে না জানিয়েছেন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা।
এদিকে মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডটি সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা গ্রুপের পরিকল্পিত ঘটনা বলে দাবি করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সংখ্যক প্রবীণ রোহিঙ্গা বলেছেন, ভাসানচরের চেয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগ নেয়া উচিত। জাতিসংঘ যদি মিয়ানমারে পরিবেশ ফিরে এসেছে, শান্তিশৃঙ্খলা অনুকূলে বলে রিপোর্ট দেয়- তাহলে আমরা নিজ দেশেই ফিরে যাব। কারণ এখানে আলইয়াকিন (আরসা) সন্ত্রাসীদের জন্য কারও জীবন নিরাপদ নয় বলে জানান ওই রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার যেখানেই তাদের পাঠাবে, সেখানেই যাবেন, তাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আপত্তি নেই। মিয়ানমারে ফিরতে বেশি আগ্রহী দাবি করে রোহিঙ্গারা বলেন, প্রবাসী বা উদ্বাস্তু জীবনযাত্রা কারও জীবনে সুখ বয়ে আনে না। একটি কক্ষেই পরিবারের সবাইকে রাত কাটাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। আলইয়াকিন গ্রুপের ক্যাডাররা না গেলেও আমরা বার্মায় চলে যাব জানিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা জানায়, মাতৃভূমি (মিয়ানমার) ও নিজ ভিটা বাড়িতে বসবাসের বিকল্প নেই। জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কাছে দাবি তুলে ওই রোহিঙ্গারা জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
মিয়ানমারের মংডু টাউনশীপের বাসিন্দা ও উখিয়ার একটি ক্যাম্পে আশ্রিত একজন শিক্ষিত রোহিঙ্গা আলম (ছদ্মনাম) বলেন, সত্য কথা বললে মাস্টার মুহিবুল্লাহর মতো আমাকেও হত্যা করবে আলইয়াকিন সন্ত্রাসীরা। তিনি বলেন, গোটা কওম (রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী) খারাপ নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু সশস্ত্র ডাকু প্রকৃতির লোক আছে। যারা মিয়ানমারেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এখানেও শান্তিতে বাস করতে দিচ্ছে না। তারা বিদেশী ও বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পুরনো কিছু রোহিঙ্গা নেতা এবং এনজিওদের কাছ থেকে মাসিক কমিশন পেয়ে থাকে। গ্রুপ লিডারের নির্দেশ মতে, আলইয়াকিন ক্যাডারদের নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে যে, তারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখবে। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে প্রতিটি শিবিরে হচ্ছেটাও তাই। রাতে অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিটি ব্লকে টহল দিতে থাকে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। যে কক্ষের গৃহকর্তা প্রত্যাবাসনে রাজি বলে জানতে পারে, তার জীবনে মুহিবুল্লাহর মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের ভয়ে মুখ খোলতে নারাজ। এক কথায়-রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠালে ওই সন্ত্রাসীরা কমিশন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ভাসানচরে স্থানান্তর ও প্রত্যাবাসনের সময় ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের কড়া নিরাপত্তা দিয়েই ক্যাম্প ত্যাগ করাতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
উখিয়ার আশ্রয় ক্যাম্পের বেশিরভাগ রোহিঙ্গার ভাসানচরের বিষয়ে তাদের ইতিবাচক বক্তব্য পাওয়া গেছে। ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ায় আমরা খুশি বলে উল্লেখ করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প এর মাঝি মোঃ নুর বলেন, সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাসানচরে বন্যা হয় বলে একটা ভীতি ছিল। তবে ইতোপূর্বে যারা গেছে- তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। নেই কোন সমস্যাও। আমরা মিয়ানমারে যেতে চাই। জাতিসংঘ আমাদের সেই ব্যবস্থাটা করুক। ভাসানচর নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে ভুল ধারণা ছিল, তা কেটে গেছে। জাতিসংঘ সেখানে যাওয়াতে এখন এই ভুলটা তাদের মধ্যে আর নেই। জাতিসংঘ সেখানে যাওয়াতে রোহিঙ্গারা সকল সুবিধা পাবে- এমন ধারণা ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের মধ্যে শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে আলইয়াকিন সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যুর চেয়ে বর্তমানে ভাসানচরই নিরাপদ মনে করছে। সেখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম কম হবে বলেও মনে করেন তারা।